মানুষের আয় কম, ব্যয় বেশি, ছোট করতে হচ্ছে বাজারের ফর্দ

টানা ২৪ মাস ধরে দেশে মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম।

রাজধানী ঢাকার দক্ষিণখানের আশকোনা এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ শহীদ। ভাড়ায় গাড়ি চালান। মাসে তাঁর আয় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। তবে এই আয় দিয়ে বাসাভাড়া, সন্তানের পড়াশোনা, বাজার, চিকিৎসা—এসব খরচ এখন আর চলছে না।

গত দু-তিন বছরে আয়ের তেমন শ্রীবৃদ্ধি নেই মোহাম্মদ শহীদের, কিন্তু খরচ বেড়েছে অনেক। গলির মুদিদোকানে বাকির খাতা দিনে দিনে ভারী হচ্ছে। প্রয়োজন মেটাতে মাসের শেষের দিকে অনেক সময় ধারদেনাও করতে হয় তাঁকে।

মোহাম্মদ শহীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত এক-দেড় বছরে চাল, ডাল, চিনি, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়েছে। কিন্তু গাড়ির ভাড়ার ব্যবসা তেমন বাড়েনি। ফলে আগের আয় দিয়ে আর সংসার চালানো যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে কয়েক মাস আগে ফ্ল্যাট বাসা ছেড়ে টিনশেডের বাসা ভাড়া নিয়েছি।’

সংসার চালানোর এমন ভোগান্তি শুধু গাড়িচালক মোহাম্মদ শহীদের একার নয়। প্রায় দুই বছর ধরেই কষ্টে আছেন দেশের নিম্ন আয় ও সীমিত আয়ের মানুষ। এ সময়ে তাঁদের আয় তেমন বাড়েনি, কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম মোটামুটি হাতের নাগালের বাইরে চলে গেছে। সংসার চালাতে ধারদেনাও করতে হচ্ছে। ছোট করতে হয়েছে বাজারের ফর্দ।

গত এক-দেড় বছরে চাল, ডাল, চিনি, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়েছে। কিন্তু গাড়ির ভাড়ার ব্যবসা তেমন বাড়েনি। ফলে আগের আয় দিয়ে আর সংসার চালানো যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে কয়েক মাস আগে ফ্ল্যাট বাসা ছেড়ে টিনশেডের বাসা ভাড়া নিয়েছি।
মোহাম্মদ শহীদ, আশকোনা এলাকার বাসিন্দা

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, টানা ২৪ মাস অর্থাৎ দুই বছর ধরে মূল্যস্ফীতির হারের তুলনায় মানুষের মজুরি বৃদ্ধির হার কম। এর মানে, প্রতি মাসে যতটা মূল্যস্ফীতি হচ্ছে, মজুরি বাড়ছে তার চেয়ে কম হারে। বিপুলসংখ্যক মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয়ের গতি বেশি। ফলে ক্রয়ক্ষমতা ক্রমাগত কমছে। তাই খরচের গতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন দরিদ্র ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ।

দুই বছর ধরে চালের দাম ওঠানামার মধ্যে আছে। মোটা চালের কেজি এখন ৫০ টাকার বেশি। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবেই, প্রতি কেজি চিকন চালের দাম ৭৬ টাকা। দুই বছরের ব্যবধানে পেঁয়াজ, আলু, পটোল, বেগুন—এসবের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। এক কেজি রুই মাছ ৩০০ টাকার নিচে পাওয়া যায় না। ১৮০ টাকার কমে পাঙাশের কেজি মিলবে না। ব্রয়লার মুরগির দাম ২০০ টাকার বেশি। ২০২২ সালে সয়াবিন তেলের দাম ২০০ টাকা ছাড়ালেও এখন ১৬৪ টাকা লিটারে বিক্রি হচ্ছে।

খাবারের দাম বাড়লে মানুষের কষ্ট বাড়ে। কারণ, খাবার কিনতেই আয়ের অর্ধেকের বেশি খরচ করেন গড়পড়তা মানুষ। অর্থনীতিবিদদের হিসাবে, গরিব মানুষকে খাবার কিনতে আয়ের দুই-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত খরচ করতে হয়। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৭১ শতাংশ মানুষই খাবারের দাম নিয়ে উদ্বিগ্ন।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তৈরি পোশাকসহ কয়েক খাতটি খাত ছাড়া বাকি খাতগুলোর ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ করা হয়নি। সরকারি খাতে ৫ শতাংশ হারে যে বেতন–ভাতা বাড়ছে, তা–ও মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম। ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের সংগতি না থাকায় চাহিদা অনুযায়ী খাবার কিনতে সাধারণ মানুষের সমস্যা হচ্ছে। ফলে বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা, এমনকি বিবিএসের পরিসংখ্যানেও দেখা গেছে, দেশে পুষ্টি নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে।’

আরও পড়ুন
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবেই, প্রতি কেজি চিকন চালের দাম ৭৬ টাকা। দুই বছরের ব্যবধানে পেঁয়াজ, আলু, পটোল, বেগুন—এসবের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। এক কেজি রুই মাছ ৩০০ টাকার নিচে পাওয়া যায় না। ১৮০ টাকার কমে পাঙাশের কেজি মিলবে না। ব্রয়লার মুরগির দাম ২০০ টাকার বেশি। ২০২২ সালে সয়াবিন তেলের দাম ২০০ টাকা ছাড়ালেও এখন ১৬৪ টাকা লিটারে বিক্রি হচ্ছে।

মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে

টানা ১৪ মাস ধরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে প্রথম মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ ছাড়ায়। এরপর তা আর কখনোই ৯ শতাংশের নিচে নামেনি। সর্বশেষ গত এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অর্থাৎ ১৪ মাস ধরে আপনি যত পণ্য ও সেবা কিনছেন, তার জন্য আপনাকে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে গড়ে ৯ শতাংশ বেশি দাম দিতে হচ্ছে। যেমন গত বছরের এপ্রিল মাসে আপনি পণ্য কিনতে যদি ১০০ টাকা খরচ করেন, এ বছর এপ্রিল মাসে একই পণ্য কিনতে ১০৯ টাকা ৭৪ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।

মূল্যস্ফীতি একধরনের করের মতো, যা ধনী-গরিবনির্বিশেষে সবার ওপর চাপ বাড়ায়। উচ্চ মূল্যস্ফীতি এখন অর্থনীতির অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। সর্বশেষ গত এপ্রিল মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি আবারও ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।

কোভিড মহামারির পর ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। পাশাপাশি সংকটের কারণে দেশে ডলারের দাম বাড়ে এবং এর প্রভাবে পণ্যের দাম আরও বেড়ে মূল্যস্ফীতি উসকে দেয়। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে পূর্বাভাসে দেওয়া হয়েছে, বাংলাদেশ বেশি আমদানি করে এমন ১০টি পণ্যের মধ্যে ছয়টির দাম কমবে, আর ৪টি পণ্যের দাম বাড়বে।

তৈরি পোশাকসহ কয়েক খাতটি খাত ছাড়া বাকি খাতগুলোর ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ করা হয়নি। সরকারি খাতে ৫ শতাংশ হারে যে বেতন–ভাতা বাড়ছে, তা–ও মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম। ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের সংগতি না থাকায় চাহিদা অনুযায়ী খাবার কিনতে সাধারণ মানুষের সমস্যা হচ্ছে। ফলে বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা, এমনকি বিবিএসের পরিসংখ্যানেও দেখা গেছে, দেশে পুষ্টি নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে।
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান

মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরির হার কম

জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় আয় বেশি বাড়লে মানুষের তেমন সমস্যা হয় না। সরকারের মন্ত্রীরা একসময় এই যুক্তি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ে সমালোচনার জবাব দিতেন। কিন্তু টানা দুই বছর ধরে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম। এর মানে, দুই বছর ধরে আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হচ্ছে। দেশে সাধারণত মজুরি বৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি ১-২ শতাংশ কম থাকে।

২০২২ সালের মে মাসে মূল্যস্ফীতি জাতীয় মজুরি বৃদ্ধির হারকে ছাড়িয়ে যায়। বিবিএসের হিসাবে, ওই মাসে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ, আর মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। পরের দুই বছরে মজুরি বৃদ্ধির হার একবারের জন্যও মূল্যস্ফীতিকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি।

সর্বশেষ গত এপ্রিল মাসে জাতীয় মজুরির হার ছিল ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ, আর মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। গ্রাম-শহরনির্বিশেষে ১৪৫টি নিম্ন দক্ষতার পেশার মজুরির ওপর এই হিসাব করে থাকে বিবিএস। মজুরিনির্ভর এই বিশাল জনগোষ্ঠীর ওপরই মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি পড়ে। বিবিএসের হিসাবে, দেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। এমন কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ৬ কোটির মতো।

এ বিষয়ে বিবিএসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম হলে নিম্ন আয়ের মানুষেরা বেশি চাপে থাকেন। তাঁদের সংসার চালাতে খরচ কাটছাঁট করতে হয়। এতে জীবনযাত্রার মান কমে যায়।

আরও পড়ুন

ন্যূনতম মজুরির ১৮ খাতের মেয়াদ শেষ

বিভিন্ন খাতের শ্রমিকদের জন্য ঘোষিত ন্যূনতম মজুরিকাঠামোর মেয়াদ সাধারণত পাঁচ বছর। বর্তমানে ৪২টি এমন খাত রয়েছে। ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৩টি খাতের মজুরিকাঠামোর সময়সীমা পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে।

এই খাতগুলো হলো টাইপ ফাউন্ড্রি, পেট্রলপাম্প, আয়ুর্বেদিক কারখানা, আয়রন ফাউন্ড্রি ও প্রকৌশল ওয়ার্কশপ, অয়েল মিলস অ্যান্ড ভেজিটেবল প্রোডাক্টস, সল্ট ক্রাশিং, কোল্ডস্টোরেজ, ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত অদক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিক ও কিশোর শ্রমিক, সিনেমা হল, ম্যাচ ইন্ডাস্ট্রি, জুট প্রেস অ্যান্ড বেলিং, বাংলাদেশ স্থলবন্দর, হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, সোপ অ্যান্ড কসমেটিকস, ফার্মাসিউটিক্যালস, টি প্যাকেটিং, জাহাজভাঙা, ট্যানারি, দরজি কারখানা, কটন টেক্সটাইলস, বেকারি, বিস্কুট ও কনফেকশনারি, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ, অ্যালুমিনিয়াম অ্যান্ড অ্যানামেল।

আরও পড়ুন

কোনো কোনো খাতের ন্যূনতম মজুরিকাঠামোর মেয়াদ দশক পেরিয়েছে। এসব খাতের ন্যূনতম মজুরি ৫২১ থেকে ৭ হাজার ৪২০ টাকার মধ্যে।

সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আগামী বাজেটে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জোরালো পদক্ষেপ থাকা উচিত। পরিবার কার্ডের সংখ্যা বাড়ানো; শহরের গরিবদের জন্য নতুন কর্মসূচি নেওয়া; স্কুলে মিড ডে মিল—এসব চালু করা দরকার। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এসব উদ্যোগ নিতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত লাগবে। এ ছাড়া বাজার ব্যবস্থাপনা ও তদারকিতে নজর দিতে হবে। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন জরুরি হয়ে পড়েছে।