বাংলাদেশের চেয়ে বেশিবার আইএমএফের ঋণ নিয়েছে পাকিস্তান

অর্থনীতি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা সমস্যায় পড়েছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান। এসব সমস্যা সামাল দিতে দুটি দেশই বারবার দ্বারস্থ হয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে। এ পর্যন্ত ২৪ বার আইএমএফের শরণাপন্ন হয়েছে পাকিস্তান। নিজেদের অর্থনীতি ঠিক করতে আইএমএফের সঙ্গে নানা শর্তের ঋণ কর্মসূচিতে জড়িয়েছে দেশটি। অন্যদিকে স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ১১ বার আইএমএফের সহায়তা নিয়েছে বাংলাদেশ। অবশ্য ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর পাকিস্তানকে আইএমএফের কাছে যেতে হয়েছে ২১ বার।

বিশ্বের কোনো দেশ অর্থনীতি নিয়ে সংকটে পড়লে ঋণের জন্য প্রথমেই যে সংস্থাটির কথা মনে পড়ে, সেটি আইএমএফ। বিভিন্ন দেশকে অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধারে নানা শর্তে ঋণ দেয় সংস্থাটি।

দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানকে পরাজিত করে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত অনেক মজবুত হয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের অর্থনীতি আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। মাথাপিছু আয়, রপ্তানি আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের তুলনায় এখন পাকিস্তানের অর্থনীতি অনেক দুর্বল ও ভঙ্গুর। দেশটির রাজস্বব্যবস্থা এত বছরেও ভালো হয়নি। সামরিক খাতে পাকিস্তান বেশি খরচ করে। অর্থনীতি দুর্বল বলে পাকিস্তানকে বারবার আইএমএফের কাছে যেতে হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে রক্ষণশীল নীতি নিয়ে বাজেট ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ বিদেশি ঋণ নিয়ে কখনো বিপাকে পড়েনি।

কে কবে গেছে
আইএমএফের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫০ সালের জুলাইয়ে আইএমএফের সদস্য হয় পাকিস্তান। আর ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসার দুই মাসের মাথায় আইএমএফের দ্বারস্থ হন। ওই বছর আইএমএফের সঙ্গে আড়াই কোটি ডলারের ঋণচুক্তি করে পাকিস্তান। এরপর ১৯৬৬ ও ১৯৬৯ সালে আইএমএফ থেকে যথাক্রমে ৩ কোটি ৭৫ লাখ ডলার ও সাড়ে ৭ কোটি ডলার ঋণ নেয় পাকিস্তান।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের কারণে পাকিস্তানের অর্থনীতি আরও খারাপ হয়। ফলে ১৯৭২, ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে পরপর তিন বছর আইএমএফের কাছে যায় পাকিস্তান। তখন তিনবারে সব মিলিয়ে ২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার ঋণ নেয় দেশটি। এরপর দেশটি সবচেয়ে বেশি আইএমএফের দ্বারস্থ হয় নব্বইয়ের দশকে। ওই দশকে সর্বমোট ছয়বার আইএমএফের ঋণ নিতে হয়েছে।

২০২১ সাল থেকে সর্বশেষ অর্থনৈতিক সংকট শুরু হয় পাকিস্তানে। পরবর্তী ২ বছরে এ সংকট আরও তীব্র হয়। তাই ২০২২ সালে আইএমএফের কাছে ৩০০ কোটি ডলার জরুরি ঋণসহায়তা চায় পাকিস্তান সরকার। গত বছর এ ঋণ দিতে সম্মত হয় আইএমএফ। সব মিলিয়ে পাকিস্তান এ পর্যন্ত আইএমএফ থেকে প্রায় ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের মতো ঋণ নিয়েছে।

অপর দিকে ১৯৭২ সালে আইএমএফের সদস্য হয় বাংলাদেশ। পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি কম চাপে পড়েছে। তাই আইএমএফের কাছেও যেতে হয়েছে কম। বাংলাদেশ প্রথম আইএমএফের দ্বারস্থ হয় ১৯৭৪ সালে। ওই বছর ৩ কোটি ১২ লাখ ডলার ঋণ নেয় বাংলাদেশ। এরপর ১৯৭৫ ও ১৯৭৯ সালে দুইবার আইএমএফের ঋণ নিতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। তবে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশিবার আইএমএফের শরণাপন্ন হয় আশির দশকে। ১৯৮০, ১৯৮৩, ১৯৮৫ ও ১৯৮৭ সালে সব মিলিয়ে ১১৩ কোটি ডলারের ঋণ নেয়। এ ছাড়া নব্বইয়ের দশকে একবার, ২০০৩ ও ২০১২ সালে দুবার ও সর্বশেষ গত বছর একবার আইএমএফ থেকে নানা কর্মসূচির আওতায় ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে গত ৫৩ বছরে আইএমএফের সঙ্গে সাড়ে ৭০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি করেছে বাংলাদেশ।

অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে এগিয়ে বাংলাদেশ
এ ছাড়া রিজার্ভ, ডলারের দাম, রপ্তানি, মূল্যস্ফীতি, মাথাপিছু আয়—অর্থনীতির এসব সূচকেও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৫ মার্চ দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১ হাজার ৩৩৯ কোটি মার্কিন ডলার। অন্যদিকে আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী, গত সপ্তাহ শেষে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১ হাজার ৯৯৮ কোটি ডলার।

দুই দেশে সাম্প্রতিক সময়ে স্থানীয় মুদ্রার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে। তারপরও বাংলাদেশের চেয়ে পাকিস্তানে ডলারে দাম বেশি। বর্তমানে পাকিস্তানে ১ ডলারের দাম দেশটির মুদ্রায় ২৭৯ রুপি। আর বাংলাদেশে ১ ডলারের দাম ১১০ টাকা।

দুই দেশেই ডলার প্রবাহের অন্যতম উৎস প্রবাসী ও রপ্তানি আয়। রপ্তানি আয়ের দিক থেকেও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলার রপ্তানি আয় করেছে। অন্যদিকে গত অর্থবছরের পাকিস্তানের রপ্তানি আয় ছিল ৩ হাজার ৮৬০ কোটি ডলার। তবে উভয় দেশেই ২০২৩ সালে প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ প্রবাসী আয় এসেছে।

সার্বিকভাবে বাংলাদেশের চেয়ে পাকিস্তানের মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ অনেক বেশি। বাংলাদেশে গত ফেব্রুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অন্যদিকে পাকিস্তানে ওই মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ২৩ শতাংশের বেশি।

মাথাপিছু আয়েও পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে বাংলাদেশ। ডলারের হিসাবে গত অর্থবছর শেষে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৭৪৯ ডলার। অন্যদিকে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৫৫৩ কোটি ডলার।