অপেক্ষা করুন, মূল্যস্ফীতি কমবে ছয় মাস পর

সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী

অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে সবচেয়ে বেশি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন মূল্যস্ফীতি ও কালোটাকা সাদা করা নিয়ে। তিনি সবচেয়ে বেশি কথা বলেছেন মূল্যস্ফীতি নিয়ে। এ সময় তিনি কেবল আশ্বাসই দিয়েছেন।

অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সব পদক্ষেপই নিয়েছি। আর পদক্ষেপ নিয়েছি বলেই তা ৯ শতাংশের ঘরে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হয়েছে। এ ব্যাপারে আরও কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা-ও পর্যালোচনা করছি। অপেক্ষা করুন, ছয় মাস পর মূল্যস্ফীতি কমতে থাকবে।’

আরও পড়ুন
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী
ছবি: দীপু মালাকার

অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, মূল্যস্ফীতির চাপ মানুষের ওপর না পড়ার জন্যই তিনি কমিয়ে রেখেছেন বাজেটের আকার।

জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের পরদিন গতকাল শুক্রবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী এ কথাগুলো বলেন।

তবে অর্থমন্ত্রীর আশ্বাসের পরও মূল্যস্ফীতি কমবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। একই আশ্বাসের কথা শুনিয়েছিলেন বিগত সরকারের মন্ত্রীরা। গত নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারও বলেছিলেন, জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নেমে আসবে। যদিও মে মাসে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। ১৫ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি। খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও বেশি, ১০ শতাংশের ওপরে। সরকারের কোনো পদক্ষেপেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।

আরও পড়ুন

অর্থমন্ত্রীর আশ্বাসে ভরসা করতে পারছেন না কেউই। গতকাল বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, মূল্যস্ফীতি কমানোর পর্যাপ্ত উদ্যোগ বাজেটে নেই। অর্থনীতিবিদেরাও মনে করেন, বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্য এবারও পূরণ হবে না।

নতুন সরকারে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া আবুল হাসান মাহমুদ আলী এর আগে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী (২০১৪-১৮)। পেশাজীবন শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষকতা দিয়ে। পরে যোগ দেন পররাষ্ট্র ক্যাডারে। গতকালের সংবাদ সম্মেলনে তিনি কখনো ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল, কখনো বিরক্ত, কখনো কিছুটা উত্তেজিত।

মূল্যস্ফীতি ও বাজেটের আকার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, এমন অপরিপক্ব ও সরলীকরণ প্রশ্ন তিনি আশা করেননি। সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ গোঁজামিলে ভরপুর—এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এটা একটা অগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এতে বিব্রত হয়েছি।’

ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব, যা প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় কোনো পদক্ষেপ বা বার্তা বাজেট বক্তব্যে নেই। দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তিদের কোনো বার্তা না দেওয়ার ব্যাপারে আপনার ওপর কি কোনো চাপ আছে? এ প্রশ্ন শুনেও কিছুটা উত্তেজিত হন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘খোলাখুলিভাবে এ বিষয়ে বলেছি। কোনো রাখঢাক রাখিনি। ঘুরেফিরে একই কথায় যাচ্ছেন কেন?’ তিনি আরও বলেন, ‘কীভাবে প্রশ্ন করতে হয়, সেটা তো শিখতে হবে। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, এটা কোনো সাংবাদিকতা নয়।’

সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী
ছবি: দীপু মালাকার

সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রীর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম ও অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।

শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুস সালাম, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুস শহীদ ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন মঞ্চে উপস্থিত থাকলেও কোনো কথা বলেননি।

সংবাদ সম্মেলনে অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকে সহজভাবে প্রবেশ করতে না দেওয়ায় তারা গভর্নরের বক্তব্য বর্জন করবে। সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর কোনো বক্তব্য দেননি।

সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে আগের দিন বাজেট বক্তব্যের কিছু অংশ সংক্ষিপ্ত আকারে পড়ে শোনান অর্থমন্ত্রী। এরপরই শুরু হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব। তিনি একটা করে প্রশ্ন নিয়ে তার জবাব কখনো নিজে, আবার কখনো অন্যকে দেওয়ার সুযোগ দেন।

মূল্যস্ফীতি নিয়ে অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেন, এটাকে বড় সমস্যা বিবেচনা করেই বাজেট ছোট রাখা হয়েছে। যদিও সংশোধিত বাজেটের তুলনায় একেবারে ছোট নয়।

কালোটাকা দেশের বাইরে যায়

বৈধ আয়ে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ করের প্রস্তাব করা হলেও কালোটাকা সাদা করার কর ১৫ শতাংশ, এটা কতটা নৈতিক হলো—এমন প্রশ্নের জবাব দিতে অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব দেন এনবিআরের চেয়ারম্যানকে। এনবিআরের চেয়ারম্যান বলেন, কথায় কথায় বলা হয়, কালোটাকাকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে; কিন্তু কালোটাকা যাঁরা তৈরি করেন, তাঁরা দেশের অভ্যন্তরের অর্থনীতিতে ব্যবহার করার জন্য করেন না। কালোটাকা মূলত দেশের বাইরেই বেশি চলে যায় এবং বিভিন্ন ভোগবিলাসের কাজে ব্যয় হয়ে থাকে। দেশের অর্থনীতির কাজে কালোটাকা ব্যবহৃত হয় না।

এনবিআরের চেয়ারম্যান বলেন, ‘বাজেটে প্রস্তাব আনার পর একটা কথা আসছে যে কালোটাকাকে সাদা করার জন্য এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে আমরা এভাবে দেখছি না। বিভিন্ন কারণে অপ্রদর্শিত কিছু সম্পদ থাকতে পারে। অসতর্কতার জন্য, অজ্ঞতার কারণে অথবা অন্যের মাধ্যমে আয়কর রিটার্ন দেওয়ার কারণে অনেকের সম্পদের তথ্য অপ্রদর্শিত থেকে যায়। এ ধরনের অপ্রদর্শিত অর্থ দেখানো নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন বলে দেশের ব্যবসায়ীরা আবেদন করেছেন। ব্যবসায়ীরা অপ্রদর্শিত সম্পদ আয়কর রিটার্নে দেখাতে চান, তবে সম্পদের উৎসের জবাব দিতে পারছেন না।’

অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী
ছবি: দীপু মালাকার

এনবিআরের চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘জমি কেনাবেচার ক্ষেত্রে কিছু টাকা মানুষের অজ্ঞাতেই কালো হয়ে যায় বা অপ্রদর্শিত থেকে যায়। অপ্রিয় হলেও সত্য যে এখান থেকে আমরা এখনো মুক্তি পাইনি। এ ধরনের কিছু অনিবার্য কারণে যাঁরা সম্পদ দেখাতে পারেননি, সে সম্পদ দেখানোর জন্য আমরা সুযোগ দিয়েছি। বিশ্বের অনেক দেশেই এমন সুযোগ দেওয়া হয়।’

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদসহ উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিরাও ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করতে পারবেন কি না, জানতে চাইলে জবাব দেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান। তিনি বলেন, বেনজীরের বিষয়ে দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বেনজীরের বিষয়ে এনবিআরের চেয়ারম্যান বলেন, ‘তাঁর টাকা কেইসে (মামলায়) পড়ে গেছে, এটা কীভাবে সাদা হবে। এখন ফৌজদারি মামলা চলছে।’

‘ঋণখেলাপি এক দিনে হয়নি’

সংসদ সদস্যদের বিনা শুল্কে গাড়ি আমদানির সুযোগ দেওয়াটা কতটা ন্যায্য—এ বিষয়ে মসিউর রহমান বলেন, এটা এইচ এম এরশাদ চালু করেছিলেন। একবার সুযোগ দেওয়া হলে সেটা বন্ধ করা কঠিন। বর্তমান অর্থমন্ত্রী ধন্যবাদ পেতে পারেন যে তিনি এ গাড়ি আমদানিতে শুল্ক-কর আরোপের প্রস্তাব করেছেন।

আর্থিক খাত খারাপ হয়ে গেছে। বেড়ে গেছে খেলাপি ঋণ এবং ব্যাংক কমিশন এখনো গঠিত হলো না—এসব বিষয়ে মসিউর রহমান বলেন, ঋণ খেলাপি এক দিনে হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে, খেলাপি ঋণ কমানো।

অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এখন সেটা ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।