লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র উন্মোচিত হচ্ছে: দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দীর্ঘদিন লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র উন্মোচিত হচ্ছে। বেরিয়ে আসছে প্রভিশন ঘাটতির পাশাপাশি তারল্য ঘাটতির চিত্রও। একে একে অর্থনীতির সব অসুখ প্রকাশ্যে আসছে বলে জানান তিনি। তাঁর মতে, একসঙ্গে উঠে আসা এত সব দুর্বলতা দেশের সামগ্রিক আর্থিক স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েও প্রয়োজনীয় সংস্কার হয়নি। নীতি নির্ধারণে এখনো রয়েছে স্বচ্ছতার ঘাটতি। সার্বিক বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। আর বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি তো সর্বনিম্ন পর্যায়ে।
এভাবেই আজ এক অনুষ্ঠানে অর্থনীতির চিত্র সম্পর্কে এসব কথা তুলে ধরলেন এই বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) মিলনায়তনে অনলাইন নিউজ পোর্টাল অর্থসূচক আয়োজিত ‘অর্থনৈতিক সাংবাদিকতা’ শীর্ষক বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
অর্থনীতিবিদ, গবেষক, সাংবাদিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের লেখা নিয়ে চন্দ্রাবতী একাডেমি প্রকাশিত এ বই সম্পাদনা করেছেন অর্থসূচকের সম্পাদক জিয়াউর রহমান। অনুষ্ঠানে সাংবাদিক, লেখক, সাবেক আমলারা উপস্থিত ছিলেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ৬ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। এ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ঋণগুলো লুকানো ছিল। এখন প্রকাশ পেয়েছে। আসলে আপনার শরীরে যে এত রোগ ছিল তা আপনি জানতেনই না। রোগ জানার ফলে আপনি এখন বিচলিত হয়ে গেছেন।
ঋণগুলো লুকানো ছিল। এখন প্রকাশ পেয়েছে। আসলে আপনার শরীরে যে এত রোগ ছিল তা আপনি জানতেনই না।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, রোগ নিরাময় করার জন্য সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে? পাঁচ ব্যাংক এক করা, কিছু ব্যাংকে প্রশাসক নিয়োগ করা এবং ব্যাংক কোম্পানি আইনকে পুরোনো জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে আসার উদ্যোগ ছাড়া কিছুই করা হয়নি।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, বিনিয়োগ এত যে খারাপ অবস্থায় আছে এবং ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি সর্বনিম্ন পর্যায়ে এসেছে, তাকে তেজি করার ক্ষেত্রে সুদের হারসহ অন্যান্য ব্যবস্থা তারা (সরকার) কি নিচ্ছে, তা হচ্ছে বড় বিষয়।
আমলাতন্ত্র গত সরকারকে চৌর্যবৃত্তিতে সমর্থন দিয়েছে
আমলাতন্ত্র গত সরকারকে চৌর্যবৃত্তি করার জন্য সমর্থন দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যখন সাংবাদিকদের ঢুকতে দিচ্ছিল না, তখন আমি এখানে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম যে ডালমে কুছ কালা হে। ঢুকতে না দেওয়ার বড় কারণ হলো তারা স্বচ্ছতা চায়নি। তারা চায়নি যে সাংবাদিকেরা সত্যটা জানুন।
সিপিডির এই সম্মানীয় ফেলো বলেন, ‘আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলছি আমলাতন্ত্র গত সরকারকে চৌর্যবৃত্তি করার জন্য সমর্থন দিয়ে গেছে। দুই-তিনজন মানুষের কথা বললেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান হবেন, এ জন্য অন্যতম অভিযুক্ত। আমি সেদিনও দাঁড়িয়ে এ কথা বলেছিলাম।’
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘স্বৈরতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী সমাজের ভেতরেও বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছেন অর্থনৈতিক সাংবাদিকেরা। দেড় দশকের স্বৈরশাসনের সময় এবং তার আগে সামরিকতন্ত্রের ভেতরে যখন আমরা ছিলাম, প্রত্যাশা থাকত অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের মাধ্যমে গণতন্ত্রের আকুতি প্রকাশ করব। অর্থনৈতিক সাংবাদিকেরা আমাদের হতাশ করেননি।’
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, রাজনৈতিক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যে ঘাটতি হয়েছে তা পূরণ করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছে অর্থনৈতিক সাংবাদিকতা। বেনামি ঋণের আলোচনা করতে গিয়েই এর পেছনের বড় বড় মানুষগুলোকে আবিষ্কার করেছি। টাকা পাচারের প্রতিবেদন থেকেই জানা গেল পেছনের মানুষগুলো, তাদের রাজনৈতিক সংশ্লেষ এবং ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তাদের যোগসাজশগুলো।
সামাজিক-রাজনৈতিক ‘ভূমিকম্প’ নিয়ে আশঙ্কা
প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া হঠাৎ বিদেশি বিনিয়োগ ঘোষণা ও নীতিগত অস্পষ্টতা বিনিয়োগ পরিবেশ আরও দুর্বল করছে বলে মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনীতির পথ রুদ্ধ করছে এবং প্রাকৃতিক ভূমিকম্পের পাশাপাশি সামাজিক-রাজনৈতিক ‘ভূমিকম্প’ নিয়েও আশঙ্কা আছে তাঁর।
বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগ ঘোষণায় তাড়াহুড়া করা হয়েছে। কোনো সংস্কার ছাড়া মাত্র ১৩ দিনে বিশাল বিদেশি বিনিয়োগ আনার ঘোষণা বাস্তবসম্মত নয়।দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
স্বল্পোন্নত দেশ (এলডসি) থেকে উত্তরণের পর বন্দর ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন দরকার বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তবে তিনি এ–ও বলেন, বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগ ঘোষণায় তাড়াহুড়া করা হয়েছে। কোনো সংস্কার ছাড়া মাত্র ১৩ দিনে বিশাল বিদেশি বিনিয়োগ আনার ঘোষণা বাস্তবসম্মত নয়। অপ্রকাশযোগ্য চুক্তির (এনডিএ) আড়ালে এমন সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতার ঘাটতি তৈরি হয়। তাঁর মতে, অংশীজনের অংশগ্রহণ ও স্বচ্ছতা ছাড়া বড় সিদ্ধান্ত টেকে না। আগের সরকারের সময় যেসব বৈষম্যমূলক চুক্তি হয়েছে, সেগুলোর স্বচ্ছতা না থাকায় মানুষের সন্দেহ আরও বেড়েছে।
পলিসি রেট কমানো প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল, তবে সংকোচনমূলক নীতি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কমিয়েছে। এখন স্থিতিশীলতা থেকে প্রবৃদ্ধির দিকে যাওয়ার সময় হলেও জ্বালানি, গ্যাস, ব্যাংক খাতের তারল্য ও ব্যবসায়িক প্রতিবন্ধকতা—এসব বড় সংস্কার পিছিয়ে আছে। কেবল চাহিদা ব্যবস্থাপনা নয়, সরবরাহের দিকেও সমর্থন দরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব সমর্থন পায়নি।
সাবেক সচিব ফারুক হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ইংরেজি দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক ও ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সাবেক সভাপতি শামসুল হক জাহিদ, ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুল হক। বইয়ের সম্পাদক জিয়াউর রহমান এতে স্বাগত বক্তব্য দেন। এ ছাড়া বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমান, দৈনিক সমকালের সহযোগী সম্পাদক জাকির হোসেন, ইআরএফের সভাপতি দৌলত আক্তার ও সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।