এসডিজির ৭ লক্ষ্যে করোনার হানা

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৭টিতে করোনার প্রভাব পড়েছে।

এসডিজি

নির্ধারিত সময়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে বাদ সেধেছে কোভিড-১৯। কারণ, কোভিডে এসডিজি অর্জনের কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়েছে। প্রায় দুই বছর অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে কোভিড।

মোটাদাগে এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে কোভিড-১৯ ৭টিতে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে। এগুলো হলো দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুধামুক্তি, সুস্বাস্থ্য ও ভালো থাকা, মানসম্পন্ন শিক্ষা, লিঙ্গসমতা, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন এবং শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। বাকি সূচকগুলোয় কোভিডের পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে।

সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) এসডিজি অগ্রগতি প্রতিবেদন ২০২২ চূড়ান্ত করেছে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশসহ বিশ্ব অর্থনীতিতে কোভিডের ক্ষতি কাটিয়ে পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এই পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার গতি শ্লথ করে দেয়।

২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জন কঠিন হবে। তাই এই সময়সীমা বাড়িয়ে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত করতে অন্য দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের জোরালো দাবি তোলা উচিত।
সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম

যুদ্ধের কারণে বিশ্ব সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ায় তার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। বেড়েছে পণ্যমূল্যসহ জীবনযাত্রার ব্যয়। কোভিডের গতিধারা, যুদ্ধ পরিস্থিতি, নিত্যপণ্যের দাম, অর্থনীতির পরিস্থিতি—এসবের ওপর বাংলাদেশের উন্নয়নের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির লক্ষ্য অর্জনের সময় নির্ধারণ
করা আছে।

এ বিষয়ে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, কোভিড এ দেশের দারিদ্র্য বিমোচন প্রক্রিয়ায় বড় আঘাত হেনেছে। শ্রমবাজারেও বড় ধাক্কা লেগেছে। শিক্ষা খাতে তৈরি হয়েছে ডিজিটাল বৈষম্য। করোনায় শিক্ষাব্যবস্থার যে ক্ষতি হয়েছে, তা এখনো পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি।

এ ছাড়া কোভিডের সময় গৃহে নারী নির্যাতন বেড়েছে। এসব বিবেচনায় ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জন কঠিন হবে। তাই এই সময়সীমা বাড়িয়ে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত করতে অন্য দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের জোরালো দাবি তোলা উচিত।

কোভিডের কারণে যেসব ক্ষতি

দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে জিইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে কোভিডের প্রভাবে সাময়িকভাবে দারিদ্র্য হার বেড়ে গিয়েছিল। বহু মানুষের আয় তখন কমে গিয়েছিল। চাকরি হারিয়েছিলেন অনেকে। পরে সরকার তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়।

এসডিজির ক্ষুধামুক্তি সূচকের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের মধ্যেই এই লক্ষ্য অর্জনের কথা রয়েছে। কিন্তু কোভিডের কারণে নির্ধারিত সময়ে এই লক্ষ্য অর্জনে ঝুঁকির মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, কোভিডের আগে সুস্বাস্থ্য ও ভালো থাকার সূচকটি সঠিক পথেই ছিল। কিন্তু কোভিডের কারণে দেশের মানুষ বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে। বিশেষ করে বয়স্ক, গরিব, শরণার্থী, ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠী তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে নানাভাবে ক্ষতির মুখে পড়ে।

স্বাস্থ্য খাতের পর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষা খাত। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। এ বিষয়ে এসডিজি অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়, মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য অগ্রাধিকার খাতগুলো পুনরায় মূল্যায়ন করা উচিত। এ ছাড়া বিনিয়োগের বিষয়টি আবার পুনর্বিন্যাস করা দরকার।

শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিষয়ে বলা হয়েছে, শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে আগে থেকেই চ্যালেঞ্জ ছিল। কোভিডের কারণে সেই চ্যালেঞ্জ আরও বেড়ে গেছে। বিশেষ করে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, বেকারত্ব কমানো, আর্থিক সেবা সহজলভ্য করা, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি (প্রবৃদ্ধির সুফল সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া)—এই চার খাতে বাংলাদেশকে আগের চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।

তবে কোভিডের কারণে উল্টো ঘটনাও ঘটেছে। নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন—এই লক্ষ্য অর্জনে ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে কোভিডের কারণে। মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা বেড়েছে। তবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে আরও উন্নতি করতে হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

১৭টি লক্ষ্যের মাত্র ২টি সঠিক পথে

এসডিজি অগ্রগতি প্রতিবেদনে কোন লক্ষ্য কীভাবে আছে, সেটা মূল্যায়ন করা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, মাত্র দুটি লক্ষ্য অর্জন সঠিক পথেই আছে। এ দুই লক্ষ্য হলো দারিদ্র্য বিমোচন ও মানসম্পন্ন শিক্ষা। এ ছাড়া সাতটি লক্ষ্যে আগের চেয়ে পরিস্থিতি ভালো হয়েছে।

এগুলো হলো ক্ষুধামুক্তি; সুস্বাস্থ্য ও ভালো থাকা; লিঙ্গসমতা; নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন; সাশ্রয়ী ও নিরাপদ জ্বালানি; শিল্প, উদ্ভাবন ও অবকাঠামো এবং টেকসই শহর ও জনগোষ্ঠী। যেসব লক্ষ্যে আরও মনোযোগ বাড়াতে হবে, সেগুলো হলো শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি; পানির নিচের জীবন; শান্তি, ন্যায়বিচার ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান; অংশীদারত্ব। তবে ভূ-উপরিস্থ জীবন, জলবায়ুসংক্রান্ত কার্যক্রম, দায়িত্বশীল ভোগ ও উৎপাদন, বৈষম্য হ্রাস—এসব লক্ষ্যের বিষয়ে প্রতিবেদনে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য কাউসার আহমেদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। খুদে বার্তাও পাঠানো হয়। কিন্তু তাঁর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।