ঋণ করে বিদেশি ঋণ শোধ করা হচ্ছে: সিপিডি

বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ ও ঋণ পরিশোধের বর্তমান চিত্র নিয়ে উদ্বেগের কোনো কারণ আছে কি–শীর্ষক সিপিডি ও এশিয়া ফাউন্ডেশন আয়োজিত সংলাপে অতিথিরা। গতকাল ঢাকার লেকশোর হোটেলে।ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশ এখন বিদেশি ঋণ পরিশোধে প্রতিবছর যে পরিমাণ অর্থ খরচ করছে, তার জন্য নতুন ঋণের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আদায় করা রাজস্ব ব্যবহার করে যাবতীয় পরিচালন খরচ মেটানো হয়। রাজস্ব বাজেট থেকে ঋণের সুদাসলের পুরো অর্থের জোগান দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে বিদেশি ঋণ পরিশোধে ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের সরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণ এবং পরিশোধের সক্ষমতা: উদ্বেগের কারণ আছে কি?’ শীর্ষক সংলাপের মূল প্রবন্ধে এসব কথা বলা হয়। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। রাজধানীর একটি হোটেলে এই সংলাপ অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করেছে দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন।

সংলাপে সিপিডির পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, রাশিয়া, চীনসহ বিভিন্ন উৎস থেকে বড় প্রকল্পে কঠিন শর্তের ঋণ নেওয়া হচ্ছে। ওই সব ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়ও এসে গেছে। এতে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে।

মোস্তাফিজুর রহমান মূল প্রবন্ধে বলেছেন, গত তিন অর্থবছরের বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারকে ২৪ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা ঋণ করতে হয়েছে। চলতি অর্থবছরেও প্রায় ১৫ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা ঋণ করতে হবে। বাজেটের দলিলে শুধু সুদ খরচের বরাদ্দ দেখানো হয়। বিদেশি ঋণের আসলের বড় অংশ ঋণ করে পরিশোধ করতে হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে রাজস্ব আদায়ের বিকল্প নেই।

মূল প্রবন্ধে যা আছে

মূল প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জিডিপির তুলনায় সাড়ে ১৫ শতাংশ বিদেশি ঋণ নেওয়া হয়েছে। প্রতিবছরই এই অনুপাত বেড়েছে। সর্বশেষ গত অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২১ দশমিক ৮০ শতাংশে। গত ডিসেম্বর মাস শেষে সরকারি–বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার ৩৪ কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ সরকারি ঋণ এবং ২০ শতাংশের মতো বেসরকারি খাতের ঋণ।

সিপিডির মূল প্রবন্ধে প্রতিবছর কী পরিমাণ বিদেশি ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে, এর চিত্রও দেওয়া হয়েছে। গত অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণের পুঞ্জীভূত পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৭৬ কোটি ডলার, যা আগের এক যুগের মধ্যে তিন গুণ বেড়েছে। অন্যদিকে গত অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৪৭০ কোটি ডলার শোধ করতে হয়েছে। শুধু এক বছরের ব্যবধানেই এই ঋণ পরিশোধ ১১০ কোটি ডলার বেড়েছে। এমন অবস্থায় সরকার চলতি অর্থবছরেই দাতাদের কাছ থেকে আরও ১ হাজার কোটি ডলার ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে।

২০২৬ সাল থেকে রূপপুরে বছরে কিস্তি ৫০ কোটি ডলার

বড় প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের উদাহরণ দিতে গিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে মূল প্রবন্ধে। সেখানে বলা হয়েছে, এই প্রকল্পের সুদ পরিশোধ শুরু হয়ে গেছে। এরই মধ্যে ৩৩ কোটি ডলার পরিশোধ হয়েছে। গ্রেস পিরিয়ড শেষে ২০২৬ সাল থেকে প্রতিবছর ৫০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে।

এ বিষয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঋণ করে বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু এসব প্রকল্প রপ্তানি বাড়াতে পারছে কি না, তা দেখতে হবে। এসব প্রকল্পে আয় হচ্ছে টাকায়। ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে ডলারে। ডলারের দাম বাড়ার ফলে ঋণ পরিশোধে বেশি টাকাও খরচ হচ্ছে। এমনকি বেসরকারি খাতের ঋণ পরিশোধেও রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।

অনুষ্ঠানে কথা বলেন সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান।
ছবি: প্রথম আলো

বিদেশি ঋণের প্রকল্পে খরচ বাড়ে

অনুষ্ঠানে সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ‘ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কাসহ আফ্রিকার দেশগুলোর চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। বিদেশি ঋণ কেন নেব, কীভাবে আমরা বিদেশি ঋণ পরিশোধ করব, কীভাবে আমরা রপ্তানির সক্ষমতা বাড়াব—তা নিয়ে বেশি চিন্তা করা উচিত। কারণ, রপ্তানি বাড়লে তা ঋণ পরিশোধকে সহজ করবে। এখন চিন্তা করা উচিত কীভাবে রপ্তানি আয় ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা করা যায়।’

রেহমান সোবহান আরও বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য একজন বিশেষ উপদেষ্টা আছে, যার একটি বিশাল ব্যবসায় অভিজ্ঞতা আছে। তাঁকে দুর্নীতি এবং বিশেষ সুবিধাভোগীদের মোকাবিলা করতে হবে। তাঁর মতে, ঋণ করে বড় প্রকল্প করলে ২০-৩০ শতাংশ খরচ বেড়ে যায়। এখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, প্রকল্পের খরচ বৃদ্ধি এবং ব্যবস্থাপনা বড় ইস্যু হয়ে যায়।

অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন অনুষ্ঠানে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য (ডানে)
ছবি: প্রথম আলো

বিদেশি ঋণ প্রতারণামূলক বাস্তবতা

অনুষ্ঠানে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘রাজস্ব বাজেট থেকে উন্নয়ন প্রকল্পে একটি টাকাও দিতে পারছি না। বিদেশি ঋণ পরিস্থিতি নিয়ে প্রতারণামূলক বাস্তবতার মধ্যে আছি। ঋণ নিয়ে এত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, কিন্তু শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নে এর প্রতিফলন নেই।’

প্রতারণামূলক বাস্তবতার বিষয়টি ব্যাখ্যা করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘এত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ এখনো ২৩ শতাংশে কেন আটকে আছে? বরং সরকারের হিসাবে, জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ কমেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস প্রতিবেদন অনুসারে, মানুষের গড় আয়ু কমেছে, মৃত্যুহার বেড়েছে। আবার বেকারের সংখ্যাও বেড়েছে। ২৫ শতাংশ পরিবারকে ঋণ করে চলতে হয়। গত দেড় দশকে এত কিছু করলাম; তাহলে মানুষ এসবের সুফল পেল না কেন?’

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, ‘উল্টো আমরা কী দেখলাম, ব্যাংকের টাকা ফেরত দেওয়া হয় না। শেয়ারবাজারের মাধ্যমে মধ্যবিত্তের টাকা লুটপাট হয়েছে। বৈদেশিক ঋণে মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর পুঁজি সঞ্চয়ের নতুন উৎস হিসেবে উৎসাহিত করা হয়েছে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি খাতে তা বেশি হয়েছে। আমার বিশ্বাস, মেগা প্রকল্পের সঙ্গে ওই বিশেষ গোষ্ঠীর টাকা পাচারের সংশ্লেষ পাওয়া যাবে।’

বক্তব্য দিচ্ছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ
ছবি: প্রথম আলো

আইএমএফ ও সরবরাহকারী ঋণ এড়িয়ে চলা উচিত

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও সরবরাহকারী ঋণ এড়িয়ে চলা উচিত বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘বিদেশি ঋণ নেওয়ার আগে যাচাই–বাছাই করা উচিত। আইএমএফ টাকা দিলেই নিয়ে নেব? একবার সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের সময় অর্থ দিতে চেয়েছিল আইএমএফ। অর্থমন্ত্রী নিজেও রাজি ছিলেন; কারণ, এই অর্থ দ্রুত পাওয়া যাবে। তখন আমরা বোঝালাম, এই ঋণ নেওয়া আত্মঘাতী হবে। পরে আইএমএফের ঋণ নেওয়া হয়নি।’

সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘একবার ভিয়েতনামে একটি ঋণের দর-কষাকষি করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু দেখা গেল, আমাদের দলনেতাই দর-কষাকষি বৈঠকে অনুপস্থিত ছিলেন। তাই ঋণ নেওয়ার আগে দর-কষাকষি করতে হবে। বাংলাদেশ এখন কথামালার দেশে পরিণত হয়েছে।’ তাঁর মতে, ব্যাংক খাতে সংস্কারের পরিবর্তে উল্টো পথে চলেছে; বরং ব্যাংকমালিকদের সুবিধা দেওয়া হয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান
ছবি: প্রথম আলো

বিদেশি ঋণ কীভাবে খরচ হচ্ছে—দেখা উচিত

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘বিদেশি ঋণ কোন প্রকল্পে খরচ হচ্ছে, কীভাবে খরচ হচ্ছে—এসব বিষয় বিবেচনা করা উচিত। আমরা টাকাকে অতিমূল্যায়িত করে রেখেছি। কিন্তু যখন চাপ এল, তখন সঠিক সময়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।’

মসিউর রহমান বলেন, আইএমএফের ঋণ নেওয়া হয়েছে মূলত স্বস্তির জন্য। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য কোনো সহজ শর্তের ঋণের প্রস্তাব দেয়নি। রাশিয়া স্বেচ্ছায় ঋণ দিতে চেয়েছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বড় ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া প্রায় ১০০ বছর সুফল মেলে। ভারতীয় ঋণ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছু ভুল–বোঝাবুঝি আছে।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। বক্তব্য দেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ প্রমুখ।