দর-কষাকষিতে দুর্বল সরকারের সফলতা কম

প্রথম আলো আয়োজিত ‘যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক: কোন পথে বাংলাদেশ’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, সাবেক সচিব, শিল্পোদ্যোক্তা ও বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠনের শীর্ষ নেতারা। রোববার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে।ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা পাল্টা শুল্ক শুধু বাণিজ্যের বিষয় নয়। এটি ভূরাজনৈতিক, ভূ-অর্থনৈতিক ও ভূকৌশলগত বিষয়। আগামী ১ আগস্ট কার্যকর হওয়ার কথা বিদ্যমান ১৫ শতাংশের সঙ্গে নতুন ৩৫ শতাংশ অর্থাৎ মোট ৫০ শতাংশ শুল্কহার। এ হার কমিয়ে আনতে এখন পর্যন্ত দেশটির সঙ্গে যথাযথ আলোচনা ও দর-কষাকষি করতে পারেনি বাংলাদেশ। এসব কথা তুলে ধরে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন, কোনো দুর্বল সরকার সফল দর-কষাকষি করেছে—ইতিহাসে এমন নজির খুব কম।

তবে পুরোপুরি আশা ছেড়ে দেননি ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলেন, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কার্যালয় থেকে সক্রিয়ভাবে উদ্যোগ নেওয়া হলে এখনো ভালো কিছু হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারপ্রধানের যত ধরনের যোগাযোগের উৎস আছে, সব কাজে লাগিয়ে শেষবারের মতো চেষ্টা করা উচিত।

রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক: কোন পথে বাংলাদেশ’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এসব বক্তব্য উঠে এসেছে। প্রথম আলো আয়োজিত এ বৈঠকে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও গবেষকেরা অংশ নেন।

গোলটেবিলে বক্তারা বলেন, আলোচনা করতে সরকার অহেতুক সময় নষ্ট করেছে ও ভুল লোক দিয়ে ভুলভাবে এগিয়েছে। দুই দফা আনুষ্ঠানিক আলোচনা করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সঙ্গে। অথচ পাল্টা শুল্ক কমানোর চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ যে ট্রাম্প প্রশাসন, তার সঙ্গে কোনো আলোচনাই করতে পারেনি। এমনকি বিষয়টি বুঝতেও সরকারের সময় লেগেছে। আবার এ ধরনের বিষয়ে লবিস্ট নিয়োগ করার রেওয়াজ থাকলেও সরকার তা করেনি। গত শনিবার সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের জানানো হয়েছে, ইউএসটিআর শুল্ক নির্ধারণ করবে না, করবে ট্রাম্প প্রশাসন। এখন লবিস্ট নিয়োগ করে কত দূর কী করা যাবে, সেই প্রশ্নও রয়েছে ব্যবসায়ীদের।

আরও পড়ুন

এটা শুধু শুল্ক সমস্যা নয়

আলোচনায় অংশ নিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কোনো দুর্বল সরকার সফল দর-কষাকষি করেছে, ইতিহাসে এমন নজির খুব কম। এটি এমন এক সমন্বয়হীন সরকার, যার বিভিন্ন কাজের নেতৃত্বে কে আছেন, এটা বোঝা যায় না। এ ছাড়া এ ধরনের সরকারের রাজনৈতিক বৈধতা না থাকলে সেটিও বড় দুর্বলতার অংশ হয়। বর্তমানে যেহেতু সরকার দুর্বল, সেহেতু শুল্কের আলোচনায় দুর্বলতার ঘাটতি পূরণ করতে বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনদের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন ছিল; সেটি হয়নি।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি
ছবি: প্রথম আলো

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষিতে শুল্কের বাইরেও বিভিন্ন অশুল্ক বিষয় রয়েছে উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এখানে শুধু অর্থনীতি না, এর সঙ্গে রাজনৈতিক-অর্থনীতি ও ভূরাজনীতি জড়িত রয়েছে। ফলে এটিকে যাঁরা শুধু একটা শুল্ক সমস্যা হিসেবে দেখেন, তাঁরা ঠিক দেখছেন না।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে দর-কষাকষিতে সেবা খাতের বিষয়টি একদমই সামনে আনা হয়নি। উপদেষ্টা থেকে শুরু করে অন্য যাঁরা দর-কষাকষির সঙ্গে যুক্ত আছেন, তাঁদের মুখে এটি নিয়ে কোনো কথা নেই। অথচ এই সেবা খাতের সঙ্গে আমাদের তৈরি পোশাক, ওষুধ ও অন্য রপ্তানি খাতও জড়িত।’

ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত একটা ভুল অর্থনৈতিক নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে বলে জানান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, আজ হোক, কাল হোক, এখান থেকে তারা ফিরে যেতে বাধ্য হবে। মার্কিন অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি শুরু হলে, প্রবৃদ্ধি কমলে, কর্মসংস্থান কমলে এটির উপসর্গ দেখা যাবে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে এটা আসতে পারে। ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের বিষয়টি টিকবে না। কারণ, এটি অবৈজ্ঞানিক।

আরও পড়ুন

আমাদের কার কাছে ফেলে রাখছেন

হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে আজাদ বলেন, ৪০ বছরের ব্যবসায়িক জীবনে রপ্তানি খাতে এমন সংকট দেখেননি তিনি। সরকারের উদ্দেশে এ কে আজাদ বলেন, ‘আপনারা বলছেন, সাত-আট মাসের জন্য দায়িত্বে আছেন। এরপর চলে যাবেন। কিন্তু তখন আমরা যাব কোথায়? আমাদের কার কাছে ফেলে রাখছেন?’

অভিজ্ঞতা তুলে ধরে এ কে আজাদ বলেন, এক বড় ব্র্যান্ড তাঁকে জানায়, তারা নিজ দেশের সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করেছে। তাদের ভাষ্য ছিল, তোমাদের অবস্থান দুর্বল, ভালো ফল আশা করা যাচ্ছে না। এটা শুনে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন।

এ কে আজাদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, হা–মীম গ্রুপ
ছবি: প্রথম আলো

এ কে আজাদ আরও বলেন, বাণিজ্য উপদেষ্টা তাঁকে জানান, দর-কষাকষির আলোচনায় অংশ নিয়ে ব্যবসায়ীরা কী করবেন? ৯৫ শতাংশ সমস্যা তাঁরা সমাধান করেছেন, বাকি ৫ শতাংশ নিয়ে কাজ করছেন। উপদেষ্টার যুক্তি, ২ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব কম এলেও যদি ৫০০ কোটি ডলারের বাড়তি রপ্তানি হয়, সেটাই দেশের জন্য ভালো।

এ কে আজাদ আরও বলেন, ‘এক ক্রেতা ই-মেইলে জানিয়েছেন, ১ তারিখ থেকে বাংলাদেশের ওপর যে শুল্ক বসবে, তা সরানো না গেলে শুল্কের ৩৫ শতাংশ আমাকে বহন করতে হবে। আমি সেই শুল্ক কীভাবে বহন করব?’

এ কে আজাদ বলেন, ‘সবার ধারণা, আমাদের মাথার ওপর একজন আছেন। তিনি এটা ফুঁ দিয়ে দেবেন আর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। যে কারণে আমাদের কোনোরকম মূল্যায়ন করা হচ্ছে না এবং কোনো লবিস্ট নিয়োগের চিন্তা করা হচ্ছে না।’

আলোচনায় অংশ নিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কোনো দুর্বল সরকার সফল দর-কষাকষি করেছে, ইতিহাসে এমন নজির খুব কম। এটি এমন এক সমন্বয়হীন সরকার, যার বিভিন্ন কাজের নেতৃত্বে কে আছেন, এটা বোঝা যায় না।

লবিস্টরা এখন সাড়া দিচ্ছেন কম

বাংলাদেশি পণ্যে বাড়তি শুল্ক কমানোর দর-কষাকষির জন্য লবিস্ট নিয়োগ করার চেষ্টা করছে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। সংগঠনটির সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘লবিস্ট নিয়োগে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছি। সাড়া পাচ্ছি কম। দুজন বিদেশি লবিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। একজন সাড়া দিয়েছেন।’

বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান
ছবি: প্রথম আলো

মাহমুদ হাসান খান জানান, তিন দিন আগেও তিনি আশাবাদী ছিলেন। কারণ, যাঁরা সরাসরি দর-কষাকষি করছেন, তাঁরা খুবই আত্মবিশ্বাসী। তবে দুই দিন আগে থেকে কানাঘুষা চলছে যে তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, ইউএসটিআর পাল্টা শুল্ক কমানোর চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ নয়। ট্রাম্প প্রশাসন হচ্ছে চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ।

বিজিএমইএর সভাপতি বলেন, আমলাতন্ত্রের মধ্যে দড়ি-টানাটানি বন্ধ না হলে বেসরকারি খাত এগোবে না। দুর্ভাগ্যবশত, সরকার কখনোই বেসরকারি খাতকে স্বীকৃতি দেয়নি।

‘এক ক্রেতা ই-মেইলে জানিয়েছেন, ১ তারিখ থেকে বাংলাদেশের ওপর যে শুল্ক বসবে, তা সরানো না গেলে শুল্কের ৩৫ শতাংশ আমাকে বহন করতে হবে। আমি সেই শুল্ক কীভাবে বহন করব?’
এ কে আজাদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), হা-মীম গ্রুপ

সরকারের আত্মবিশ্বাসে খেসারতের আশঙ্কা

সিপিডির আরেক সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পাল্টা শুল্ক নিয়ে সরকার ভেবেছিল, আলাপ-আলোচনা করে সমাধান করে ফেলবে। এ নিয়ে সরকারের একধরনের কৃতিত্ব নেওয়ার মানসিকতা ছিল। দর-কষাকষির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা ভেবেছিলেন, পাল্টা শুল্ককে ১০ শতাংশ বা শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনতে পারবেন। সরকারি পর্যায়ে এমন অতি আত্মবিশ্বাসের খেসারত দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে এখন।

মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি
ছবি: প্রথম আলো

মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, বাংলাদেশ অনেক বড় পোশাক সরবরাহকারী দেশ হওয়ায় ক্রেতারা এক দিনে এখান থেকে চলে যেতে পারবে না। তারা দর-কষাকষির মধ্যে আসতে চাইবে। বিদেশি বড় ক্রেতারা এই বাড়তি শুল্ক কতটুকু সইতে পারবে, তা-ও হিসাবের মধ্যে রাখতে হবে। তাদের সঙ্গেও দর-কষাকষি করার জায়গা আছে।

কূটনৈতিক চ্যানেল কাজে আসছে না

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্টা শুল্কসহ বাণিজ্য আলোচনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। যদিও তিনি মনে করেন, আলোচনা ও দর-কষাকষির জায়গা এখনো শেষ হয়ে যায়নি।

নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘মতামত নেওয়ার মতো দেশে অভিজ্ঞ বাণিজ্য-বিশেষজ্ঞ আছেন। শুনে হতাশ হয়েছি যে সেলিম রায়হানের মতো বাণিজ্য-বিশেষজ্ঞকে কাজে লাগানো হচ্ছে না। অথচ ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান সবাই নিজেদের বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগাচ্ছে।’

বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের মতামত, লবিস্ট নিয়োগ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনে থাকা ঘনিষ্ঠ পক্ষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে এখনো এগোনো যায় বলে মনে করেন নাসিম মঞ্জুর। তিনি বলেন, ‘তবে আমাদের কূটনৈতিক চ্যানেল যথেষ্টভাবে কাজে আসছে না।’

সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার
ছবি: প্রথম আলো

নাসিম মঞ্জুর বলেন, এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ২৮ কোটি ডলার থেকে রপ্তানি বেড়ে ৪০ কোটি ডলার হয়েছে। এ ধরনের প্রবৃদ্ধি বিশ্বের আর কোনো বাজারে আছে বলে জানা নেই। ইউরোপের বাজারে প্রবৃদ্ধি কমে গেছে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে কমেনি। চীন থেকে কিছু শিল্পকারখানা সরে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনের পণ্যে যতই শুল্ক হ্রাস-বৃদ্ধি করুক না কেন, চীনে এ ধরনের শ্রমঘন শিল্প থাকবে না। কারণ, চীন-ই তা চায় না। এ সুবিধা বাংলাদেশের পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, এখনো আছে।

নাসিম মঞ্জুর বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা খুবই কম মুনাফায় কাজ করেন। এই বাস্তবতায় ৩৫ বা ৩২ শতাংশ শুল্কের ভাগ বহন করার মতো সক্ষমতা নেই। অনেক ক্রেতা ক্রয়াদেশ দেওয়ার পর স্থগিত করেছে। তারা এখন ধীরেসুস্থে কাজ দিতে চায়।

সরকারের পদক্ষেপ ব্যবসায়ীদের অজানা

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘সরকার কী করছে বা হালনাগাদ কী অগ্রগতি আছে, তা ব্যবসায়ীরা জানতে পারেননি। তিনি বলেন, সরকার যদি মনে করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষির মাধ্যমে ভারত, ভিয়েতনাম বা কম্বোডিয়ার চেয়ে ভালো সুবিধা আনতে ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ত করার দরকার নেই এবং এ জন্য আমলাতন্ত্রই যথেষ্ট, তাহলে সেটা ভুল হবে।

আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ, সভাপতি, বিসিআই
ছবি: প্রথম আলো

আনোয়ার উল আলম চৌধুরী বলেন, রপ্তানি খাতটি শুধু বৈদেশিক মুদ্রা আয়েরই মাধ্যম নয়, একই সঙ্গে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বিপুল কর্মসংস্থানও জড়িত। এ বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষিতে বেসরকারি খাতের পক্ষ থেকে গত এপ্রিলেই সরকারের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। দেশের বাইরের লবিস্ট ফার্মের সঙ্গে যোগাযোগও করা হয়েছে। ওই সময় সরকার থেকে বলা হলো, তারাই চেষ্টা করছে।

বিসিআইয়ের সভাপতির মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে খাতসংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে নিয়ে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভিয়েতনামসহ প্রতিযোগী দেশগুলো কী করছে, তা-ও মাথায় রাখতে হবে। শুল্কের হার যেন শেষ পর্যন্ত প্রতিযোগী দেশগুলোর অন্তত কাছাকাছি থাকে।

বাংলাদেশের দর-কষাকষির অভিজ্ঞতা নেই

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশের দর-কষাকষির অভিজ্ঞতা নেই। পাল্টা শুল্ক নিয়ে অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের দর-কষাকষি হতাশ করেছে। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা জটিল। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ভারতের সঙ্গেও রয়েছে নানা জটিলতা। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভূকৌশলগত অবস্থান ও চিন্তাভাবনার সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়।

সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম
ছবি: প্রথম আলো

সেলিম রায়হান বলেন, বিশ্বায়নের এই নতুন পর্বে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও কৌশলগত অংশীদারত্ব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশকে বুঝতে হবে ভূরাজনৈতিক সুবিধা কোথায় আছে। কোন কোন পণ্যে বা খাতে যুক্তরাষ্ট্রে ইতিবাচক অবস্থান নেওয়া যায়।

সেলিম রায়হান বলেন, ডব্লিউটিও কার্যত অকার্যকর। যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে তাতে বোঝা যায়, তারা খুব একটা সংস্থাটির নিয়ম মেনে চলছে না। আবার শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, অন্য শক্তিশালী দেশ যেমন ভারত, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও ব্রাজিল নিজেদের স্বার্থে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা কেউই বাস্তবে ডব্লিউটিওকে সেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে না। আপাতত বাংলাদেশের উচিত ডব্লিউটিও-নির্ভরতা না বাড়িয়ে বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এগোনো।

পাল্টা শুল্ক ভূরাজনৈতিক খেলার অংশ

নিরাপত্তা বিশ্লেষক লে. জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের যে ডকুমেন্ট নিয়ে আমরা কথা বলছি, তার ভেতরে ডব্লিউটিওর কথাবার্তা চলে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের ধারণার মধ্যে ১৮ কোটি মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অংশ রয়েছে। চীনের ওপর নির্ভরতা কমানোর তাগাদা দেওয়ার বিষয়ও আছে।’

মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘আমি মনে করছি, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের বিষয়টি ভূরাজনৈতিক, ভূ-অর্থনৈতিক ও ভূকৌশলগত খেলার অংশ। আমরা শুনে আসছি যে এ অঞ্চলে শক্তিমত্তা সৃষ্টির জন্য যুক্তরাষ্ট্র সচেষ্ট। বাংলাদেশ এখন তার অংশ হয়ে গেছে।’

মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান, নিরাপত্তা বিশ্লেষক
ছবি: প্রথম আলো

রোহিঙ্গা বিষয় নিয়ে কিছু তথ্য উল্লেখ করে মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘পশ্চিমা বিশ্ব ২০২৩ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গা বিষয়ে ২৫৩ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তা করেছে বাংলাদেশকে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র একাই দিয়েছে ১৬১ কোটি ডলার। ভারত কোনো পয়সা দেয়নি। আর চীন ২০ লাখ ডলার ও রাশিয়া ৪ লাখ ডলার দিয়েছে। এদিকে ২০১৭ সালের পর মিয়ানমারকে ১৪ শতাংশ অস্ত্র দিয়েছে ভারত। এ ছাড়া চীন ২৯ শতাংশ ও রাশিয়া ৪৯ শতাংশ অস্ত্র দিয়েছে। রাশিয়া ও চীন মিয়ানমারের পাশে দাঁড়িয়েছে। এ জন্য বললাম যে কাদের আমরা পক্ষ নেব। আঞ্চলিক শক্তি ও পরাশক্তির বিপৎসীমা অতিক্রম না করে তাদের থেকে সুবিধা আদায় করতে হবে আমাদের।’

টিকফা ফোরামকে কাজে লাগানো যেত

সাবেক অর্থসচিব ও বাণিজ্যসচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, পোশাক খাত দীর্ঘ সময়ে অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে। এবারের চ্যালেঞ্জটা ভিন্নতর। একজন বলছিলেন যে তিন বছর পর ডোনাল্ড ট্রাম্প চলে গেলে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। অর্থাৎ অন্য সরকার এলে আর তা থাকবে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে যে সরকারই থাকুক না কেন, শ্রম, জেন্ডারসহ কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের নীতির ধারাবাহিকতা থাকে।

মাহবুব আহমেদ, সাবেক বাণিজ্যসচিব
ছবি: প্রথম আলো

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কাঠামো চুক্তি (টিকফা) করার সময় (২০১৩) বাণিজ্যসচিব ছিলেন মাহবুব আহমেদ। তখন বিজিএমইএ, বিকেএমইএসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছিলেন বলে স্মরণ করেন তিনি। মাহবুব আহমেদ বলেন, টিকফা সই করতে ১১ বছর সময় লেগেছে। এত সময় নেওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে আমলাতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। ছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রশি-টানাটানি।

সাবেক এই বাণিজ্যসচিব বলেন, আজ যিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আছেন, কাল হয়তো তিনি অন্য জায়গায় চলে গেছেন বা উপজেলা থেকে একজনকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ দেওয়া হলো। এভাবে দর-কষাকষির দক্ষতা তৈরি হবে না।

সরকারি পর্যায়ে অনেক জায়গায় বিশেষজ্ঞ লোকের অভাব থাকলেও বেসরকারি খাতে, চেম্বারে, সুশীল সমাজে অনেক ভালো বিশেষজ্ঞ আছেন উল্লেখ করে মাহবুব আহমেদ বলেন, ‘আমাদের দর-কষাকষির ক্ষমতা কম। শুল্ক বিষয়ে টিকফা ফোরামটাকে কেন কাজে লাগালাম না, এটা আমার প্রশ্ন। বছরে একবার বৈঠক হওয়ার কথা আছে, কিন্তু যেকোনো পরিস্থিতিতে জরুরি বৈঠক করা যায়।’

আমরা কূটনৈতিকভাবে ব্যর্থ হয়েছি

অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) চেয়ারম্যান শরীফ জহির বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক কমানোর আলোচনায় আমরা কূটনৈতিক দিক থেকে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছি। এখনো ১০ দিন সময় আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সরকারপ্রধানের যত ধরনের যোগাযোগের উৎস আছে, সব কাজে লাগিয়ে শেষবারের মতো চেষ্টা করা উচিত।’

শরীফ জহির, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অনন্ত গ্রুপ
ছবি: প্রথম আলো

শরীফ জহির বলেন, ‘পাল্টা শুল্ক না কমলে আমাদের ব্যবসা ছয় মাসের বেশি টিকতে পারবে না। ইউরোপের দেশগুলো বাংলাদেশের পোশাকের দাম কমাতে চাপ তৈরি করবে।’

ওষুধশিল্পের বিনিয়োগ পানিতে পড়বে

বাড়তি ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ হলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানির জন্য ওষুধ কোম্পানিগুলোর গত ১০-১২ বছরের বিনিয়োগ পানিতে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন ইনসেপ্‌টা ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মুক্তাদির। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ওষুধের সবচেয়ে বড় বাজার। যদিও ওষুধ রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের হিস্যা কম। দেশটিতে রপ্তানি বাড়াতে যোগ্যতা অর্জনের জন্য ১০ বছর ধরে কাজ করছি। ইতিমধ্যে ১০-১২টি কোম্পানি সেই সক্ষমতা অর্জন করেছে। তবে সমস্যাও আছে। দেশটির নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তারা তিন বছর ধরে আমাদের কারখানা পরিদর্শনে আসছেন না। অথচ আমরা টাকা জমা দিয়ে বসে আছি। এ রকম শুল্কের বাইরে অ-শুল্ক বাধাও রয়েছে।’

আবদুল মুক্তাদির, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইনসেপ্‌টা ফার্মাসিউটিক্যালস
ছবি: প্রথম আলো

ওষুধশিল্প সমিতির সভাপতি আবদুল মুক্তাদির বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষির আলোচনায় কিছু শর্ত আসছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত ওষুধ শর্তহীনভাবে বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করতে দিতে হবে। এটা ভয়ংকর শর্ত। এমনটি হলে ওষুধশিল্পে মারাত্মক প্রভাব পড়বে।

গোলটেবিল আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন।

আরও পড়ুন