আড়াই মাস আগে হারালেন পা, আগুনে পুড়ল কোটি টাকার ব্যবসা, যেমন কাটছে আশরাফুলের ঈদ

পা হারানোর পর আগুনে সর্বস্ব হারিয়েছেন ব্যবসায়ী আশরাফুল।
প্রথম আলো

চলতি মাসের ৪ তারিখে রাজধানীর বঙ্গবাজার আগুনে পুড়ে যায়। সেই সঙ্গে ধূলিসাৎ হয় ব্যবসায়ীদের স্বপ্ন। সেখানে সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৮৪৫টি দোকানের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

এর মধ্যে চাঁদপুরের কচুয়ার ব্যবসায়ী আশরাফুল ইসলামের একটি বিক্রয়কেন্দ্র ও তিনটি গোডাউন আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে। কোটি টাকার মালামাল ছিল সেখানে। তবে আশরাফুলের দুর্ভাগ্যের শুরু তারও আড়াই মাস আগে। ১৭ জানুয়ারি সকালে তিনি বাইকে ঢাকা থেকে বাড়িতে ফিরছিলেন। প্রায় পৌঁছেও গিয়েছিলেন, কিন্তু বাড়িতে পৌঁছার আধা ঘণ্টা আগে এক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন তিনি। দুই মাস চিকিৎসা নেওয়ার পর কাটতে হয় বাঁ পা।

আজ শনিবার ঈদের দিনটাও এই ব্যবসায়ীর কাছে বেশ ব্যতিক্রম। কখনো মা-বাবা ও পরিবারের সদস্যদের ছেড়ে ঈদ করেননি আশরাফুল। এবারই প্রথম ঢাকায় ঈদ করছেন। ঈদের আগের দিন যোগাযোগ করা হলে চলে যেতে বলেন রাজধানীর আগামসি লেনের দুই রুমের বাসায়। ঈদের দিনের কোনো আমেজ তো নেই, উল্টো এমন দিনে কথা বলতে এসেও ভেতরে একটা সংকোচ কাজ করছিল।

তবে সেই জড়তা তিনি নিজেই ভাঙালেন। বললেন, ‘কষ্ট করে আসছেন, বসেন।’ আশরাফুলের ছোট ভাই এহসান উল্লাহ তাঁর সঙ্গে আছেন। তিনি আলাদা করে একটি টেবিল ফ্যান চালিয়ে টুল টেনে বসতে দিলেন।

চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি বেলা ১১টায় ঘটা দুর্ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘জীবন যে কঠিন, সেটা দুর্ঘটনার দিন বুঝতে পারছি। সেদিন কাছে ছিল ৩৫ হাজার টাকা আর বাণিজ্য মেলা থেকে ভাগনিদের জন্য ৫ হাজার টাকার চকলেট ও অন্যান্য জিনিসপত্র কিনেছিলাম। অথচ রাস্তার মানুষ আমাকে উদ্ধার করার আগে টাকা আর জিনিসপত্রগুলো নিয়ে গেল।’

আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে একজন ছিল। তিনি রক্ষা পেলেও আশরাফুল ইসলামকে দীর্ঘ দুই মাসের মতো ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। রক্ত লেগেছিল ২০ ব্যাগ। একপর্যায়ে চিকিৎসকেরা তাঁর বাঁ পা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁদের খুব করে বলেছিলেন, কোনোভাবে পা-টা রাখা যায় কি না, প্রয়োজনে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেবেন; কিন্তু কাজ হয়নি।

আশরাফুল হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার ১০ থেকে ১২ দিন পর বঙ্গবাজারে আগুন লাগে। বলেন, ‘সেদিন সকালে ফোনের পর ফোন। যে মার্কেটে আগুনের সূত্রপাত, সেই আদর্শ মার্কেটেই আমার দোকান ছিল। আমি তো অসুস্থ মানুষ, চলাচলের অবস্থা নেই। বাবা আর ভাই ছিল, তারা গিয়ে টানাটানি করে সামান্য কিছু মাল বের করতে পারে। কিন্তু তিনটি গোডাউন পুরো ভরা ছিল। ওখানে একটা বিক্রয়কেন্দ্রও ছিল। সব মিলিয়ে চারটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পুড়ে একেবারে ছাই। কোটিপতি ব্যবসায়ী থেকে আমি হয়ে গেলাম শূন্য হাতের ব্যবসায়ী; যদিও পাশের মহানগর শপিং কমপ্লেক্সে আমার আরেকটা দোকান আছে। তবে চিকিৎসাবাবদ ছয় লাখ টাকার ওপর খরচ করে সঞ্চয় শেষ।

পা আর ব্যবসা হারানোর পর ভেবেই পাচ্ছিলাম না, কী করব। তখন মানুষের কাছে যে টাকা পেতাম, তার তাগাদা দেওয়া শুরু করলাম। আমার ব্যবসা মূলত গার্মেন্টসের স্টক লটের মালামালের; পাইকারিতে সারা দেশেই ব্যবসা করতাম। তবে বড় ক্রেতারা ছিলেন রাজধানীর নিউ সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ীরা।
আশরাফুল ইসলাম, ব্যবসায়ী, বঙ্গবাজার

ধারদেনা তেমন না থাকলেও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পুড়ে যাওয়ার পর আমি বাকি টাকা ওঠানোর কাজে হাত দিই। কিন্তু ভাগ্য আমার সঙ্গে আরও আরেকবার প্রতারণা করে।’
এখন সেই কাহিনি শোনার পালা। আশরাফুল ইসলামের কাছ থেকে বাকি গল্পটা শোনার আগে নিজেও কিছুটা ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করলাম। তবে এত দিনে ধাক্কা খেতে খেতে শক্ত হয়ে ওঠা আশরাফুল অনেকটা অবলীলায় বলে গেলেন সেই ঘটনা।

আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘পা আর ব্যবসা হারানোর পর ভেবেই পাচ্ছিলাম না, কী করব। তখন মানুষের কাছে যে টাকা পেতাম, তার তাগাদা দেওয়া শুরু করলাম। আমার ব্যবসা মূলত গার্মেন্টসের স্টক লটের মালামালের; পাইকারিতে সারা দেশেই ব্যবসা করতাম। তবে বড় ক্রেতারা ছিলেন রাজধানীর নিউ সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ীরা।

এরপর সেই মার্কেট যখন পুড়ে গেল, তখন আর কিছু ভাবতে পারিনি। সেখানকার ব্যবসায়ীদের কাছে আমার এখনো ১০ লাখ টাকার ওপর পাওনা। আমার মতো তাঁদেরও সব পুড়ে ছাই। তাই এই টাকা এখন চাওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। ইতিমধ্যে বাকি টাকা যেটুকু আদায় হয়েছে, তা দিয়ে যে দোকানটা পুড়েনি, সেখানে মালামাল তুলেছিলাম। ঈদের আগে বেচাকেনা হবে আশা ছিল, কিন্তু রোজায় প্রতিদিন কর্মচারীদের ইফতারের টাকাও ওঠেনি।’

অনেকটা সিনেমাকে হার মানানো এই গল্প শুনতে শুনতে ঈদ কেমন কাটছে, সেই প্রশ্ন অনেকটা অবান্তরই মনে হলো। বাস্তবতা হলো, আশরাফুল ইসলামের ঘরে তো বটেই, পুরো পরিবারেই ঈদের আমেজ নেই। সে জন্য তিনি বাড়িতে না গিয়ে ঢাকাতেই আছেন। একা একাই দিনটা পার করে দিতে চেয়েছিলেন। তবে সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ছোট ভাই। কথা চলাকালীন আশরাফুল ইসলামের জন্য রান্না করা খাবার নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন তাঁর ফুফাতো ভাই সোহেল মজুমদার। আর সঙ্গে ছিলেন ব্যবসায়িক সূত্রে বন্ধু ও মাদারীপুরের শিবচর থেকে তাঁকে দেখতে আসা রবিউল ইসলাম। দুজন মিলে আশরাফুল ও তাঁর ভাইয়ের জন্য পোলাও-মাংস আর ফিরনি-পায়েস নিয়ে এসেছেন।

ফুপাতো ভাই ও বন্ধুর সঙ্গে আশরাফুল(মাঝে)
প্রথম আলো

আশরাফুলের ফুফাতো ভাই সোহেল মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষের ভাগ্য খারাপ হয় দেখেছি। মানুষ বিপদে পড়ে, কিন্তু এটা কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না। কাছাকাছি বয়স হওয়ায় ছোটবেলা থেকে আমরা প্রায় একসঙ্গে বেড়ে উঠেছি। কখনো ভাবিনি এমন পরিস্থিতি হবে। তবে আমরা সবাই তার পাশে আছি। আমি তো হাসপাতালের পুরোটা সময় ছিলাম। বলতে গেলে সবাই ছিল। সব সময় পুরো পরিবার তার পাশে আছে। আশা করি দ্রুত এই দুর্ভাগ্যের অবসান হবে।’

পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন আশরাফুলের বন্ধু রবিউল ইসলামও। তিনি বলেন, ব্যবসায়িক সূত্রেই আমাদের পরিচয়। অনেক দিন ধরে একসঙ্গে ওঠাবসা। তাকে সব সময় পরিশ্রম করতে দেখেছি; বসে থাকত না। সেই তাকে এখন বিছানায় পড়ে থাকতে হচ্ছে, এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। ব্যবসা পুড়েছে, সেটা অবশ্যই বড় ক্ষতি। কিন্তু সে যেভাবে মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে দোকানের কর্মচারী থেকে বড় ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছিল, তাতে সুস্থ থাকলে অবশ্যই ব্যবসায় ফেরা তার জন্য খুব বেশি কঠিন হতো না।’

যেভাবে শুরু করেছিলেন ব্যবসা

২০১৪ সালে চাঁদপুরের কচুয়ার স্থানীয় আশেক আলী খান উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করার পর ঢাকায় বঙ্গবাজারের একটি দোকানের কর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করেন আশরাফুল ইসলাম। ২০১৯ সঙ্গে নিজের ব্যবসা চালু করেন তিনি। গাজীপুর, সাভার, মিরপুর ও চট্টগ্রামের গার্মেন্টস থেকে স্টক লটের পুরুষদের পোশাক এনে পাইকারিতে বিক্রি করতেন। বড় ভাগনির নামে (তানহা গার্মেন্টস) এই ব্যবসা করেন তিনি। একটা একটা করে গোডাউনসহ মোট পাঁচটি দোকানের মালিক হয়েছেন। এখন একটা দোকান আছে, যেখানে মালামাল খুব বেশি নেই। তবে সেখান থেকে নতুন করে শুরু করা ছাড়া বিকল্প কিছু ভাববেন না তিনি।

এ বিষয়ে আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘শিখেছি এই একটা কাজ, এটা করেই খেতে হবে। তবে এখন আমার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা আমার শরীর। এক পায়ে চলাচল করতেও নানা অসুবিধা। এখনো অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি। দেখি, আল্লাহ যদি টিকে থাকার মতো একটা ব্যবস্থা করে দেন, তাহলে কৃত্রিম পা লাগানোর চিন্তাও আছে।’ মাত্র ২৫ বছর বয়সী এই যুবক এখনো সংসার শুরু করেননি। সর্বশেষ হাসতে হাসতে বললেন, ‘ভাই, আল্লাহ চাইলে একদিন সবকিছু হবে।’

আলাপচারিতার শেষ দিকে এসে মনে হয়েছে, এমন প্রাণশক্তি থাকলে প্রকৃত অর্থেই ফিরে আসা সম্ভব। তবে সময় সেটা বলে দেবে। ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে আশরাফুলের দুই রুমের বাসা থেকে বিদায় নিতে নিতে মাথায় বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল, নিয়তি মানুষকে কতভাবেই-না পরীক্ষা করে।