৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি

গত জুন মাসে মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এর আগে ২০১৩ সালের জুলাই মাসে এই হার ছিল ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশ অতিক্রম করা মানেই দুঃসংবাদ। এতে সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অসহনীয় হয়ে ওঠে। গত মে মাসেই মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। জুন মাসে তা আরও বাড়ল। দেশের মূল্যস্ফীতির হার এখন ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এর আগে ২০১৩ সালের জুলাই মাসে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। অর্থাৎ বিগত ৯ বছরে এই জুন মাসের মতো এত মূল্যস্ফীতি আর হয়নি।

গতকাল মঙ্গলবার মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ এ তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। উচ্চমূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এখন অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

মূলত পাঁচ মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। গত জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের নিচে ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে তা ৬ শতাংশ অতিক্রম করে। এরপর থেকেই ধারাবাহিকভাবে বেড়ে চলেছে মূল্যস্ফীতির হার। তবে অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ নয়, প্রকৃত মূল্যস্ফীতি আসলে আরও বেশি। বিশেষ করে গরিব মানুষের ওপর এই মূল্যস্ফীতির চাপ ১০ শতাংশের বেশি।

‘আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতির কারণে দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়েছে। তবে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার কম।’
শামসুল আলম, উচ্চমূল্যস্ফীতি সম্পর্কে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী

কয়েক মাস ধরেই বাজারে চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে বাজারে। বাজারে সব ধরনের পণ্যেরই দাম বাড়তি আছে। এর ফলে গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষকে ভুগতে হচ্ছে। এসব কারণে কয়েক মাস ধরে মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জন্য আবারও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে ছয় মাস ধরে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার কারণে গত অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৪ শতাংশে ধরে রাখার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছরে (জুলাই-জুন)
গড়ে ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। এর মানে, মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ঠিক থাকেনি। নতুন ২০২২–২৩ অর্থবছরে অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে রাখবেন বলে বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন।

উচ্চমূল্যস্ফীতি সম্পর্কে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতির কারণে দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়েছে। তবে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার কম।’ তিনি আরও বলেন, বর্ষাকালে বিশেষ করে জুলাই থেকে অক্টোবর সময়ে মূল্যস্ফীতি একটু বাড়ে। কারণ, এ সময়ে উৎপাদন ব্যাহত হয়। ধান, শাকসবজির মৌসুম নয় বলে বাজারে এসবের দাম কিছুটা বাড়ে। মূল্যস্ফীতির চক্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ সময় সাধারণত খাদ্যমূল্য কিছুটা বৃদ্ধি পায়।

বাজারে মোটা চালের দাম কেজিতে ৫ থেকে ৮ টাকা বেড়ে এখন ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভোজ্যতেলের দাম লিটারপ্রতি দাম ২০০ টাকা পেরিয়েছে। আর ডালের দাম গড়ে ১০ টাকা বেড়েছে। চিনির দামও কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। এ ছাড়া খাতা-কলম, পোশাক, পরিবহন খরচ—সবই বেড়েছে। অর্থাৎ প্রায় সব ক্ষেত্রেই রয়েছে মূল্যবৃদ্ধির চাপ।

আরও পড়ুন

গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ৯%

গত জুন মাসে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত—দুই ধরনের পণ্যেই মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন শেষে দেশে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। গত মে মাসে এই হার ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর জুন মাসে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ। গত মে মাসে এই হার ছিল ৬ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ।

এর মানে হলো, চাল-ডাল, তেল-নুন, মাছ-মাংসসহ খাদ্যপণ্য কিনতে গিয়ে মানুষ বেশি চাপে আছে। শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষ এই চাপ বেশি অনুভব করছেন। কারণ, শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি বেশি। বিবিএসের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসে গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। একই সময়ে শহরাঞ্চলে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ।

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসে গ্রামাঞ্চলে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি পৌঁছেছে ৮ দশমিক ৯৩ শতাংশে। শহরাঞ্চলে এই হার ৭ দশমিক ১১ শতাংশ।

মজুরির বৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি

মূল্যস্ফীতি একধরনের করের মতো। জিনিসপত্রের দাম বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজুরি বা আয় না বাড়লে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়ে। তাদের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। ফলে দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে থাকা বহু মানুষের আবার গরিব হওয়ার শঙ্কা থাকে।

বিবিএসের মূল্যস্ফীতি ও জাতীয় মজুরি সূচক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সাধারণত মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার বেশি থাকে। কয়েক মাস ধরেই এর ব্যতিক্রম। বিবিএস বলছে, ২০১০-১১ ভিত্তিবছর ধরে গত জুন মাসে জাতীয় মজুরি বৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ, যা সার্বিক মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম।

এর মানে, যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, সেই হারে মজুরি বাড়ছে না। ফলে মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। বিশেষ করে গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি পড়ছে।

গত নভেম্বর মাসে দেশে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে গত ডিসেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ অতিক্রম করে। অবশ্য জানুয়ারি মাসে তা আবার ৬ শতাংশের নিচে নেমে যায়। এরপর ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হয়, যা মূল্যস্ফীতিকে আরেকটু দফা উসকে দেয়।

মূল্যস্ফীতি আবার ৬ শতাংশে উঠে যায়। সর্বশেষ তিন মাস ধরে চলমান ডলার–সংকট আমদানি ব্যবস্থাকে টালমাটাল করে তোলে। সার্বিকভাবে আমদানিকারকদের আমদানি খরচ বেড়ে যায়। এর ফলে গত মে ও জুন মাসে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশের ওপরে উঠে গেছে।