কর্মপরিকল্পনায় পাঁচ বিষয়ে জোর দিতে হবে: দেবপ্রিয়

দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম আয়োজিত সংলাপে বক্তব্য দেন শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। গতকাল রাজধানীর পল্টনে ইআরএফ কার্যালয়েছবি: প্রথম আলো

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ছয় মাসের কার্যক্রমের মূল্যায়নের পাশাপাশি পরবর্তী ছয় মাসের কর্মপরিকল্পনা করতে হবে। সেখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ চালু রাখা, সরকারি ব্যয়ের দক্ষতা বৃদ্ধি, কর আহরণ বাড়ানো ও বৈদেশিক খাতের ব্যবস্থাপনায় জোর—এ পাঁচটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। এ ছাড়া ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে বিদেশি সহযোগীদের নিয়ে উন্নয়ন ফোরাম করতে হবে। সেখানে বাজেট অর্থায়ন ও এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাজারসুবিধা প্রাপ্তির বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা দরকার।

দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত এক সংলাপে এসব পরামর্শ দেন অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, বছর শেষে অন্তর্বর্তী সরকারকে নিজেদের মূল্যায়ন করতে হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জন্য এই মূল্যায়ন দরকার। একই সঙ্গে মানুষের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি করতে অন্তর্বর্তী সরকার কী করতে চায়, সেটিও সুনির্দিষ্ট করে বলতে হবে।

অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ), বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান র‍্যাপিড এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল বাজেট পার্টনারশিপ যৌথভাবে এই সংলাপ আয়োজন করে। তাতে বাজেটের উন্মুক্ততা নিয়ে পরিচালিত এক জরিপের ফলাফলও তুলে ধরা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর পল্টনে ইআরএফ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন র‌্যাপিডের চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক। জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন র‌্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক আবু ইউসুফ। বক্তব্য দেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আনোয়ারুল কবির, প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন, ইআরএফের সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা। সংলাপটি সঞ্চালনা করেন ইআরএফের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।

দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে জটিল বলে উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বিগত সরকারের আমলে শুধু বেপরোয়া নয়, বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছায় অর্থনীতি। প্রচলিত সংশয়ের থেকেও পরিস্থিতি জটিল ছিল। এ রকম একটা অর্থনীতি যখন উত্তরাধিকার সূত্রে কোনো সরকার পায়, তখন সহজ সমাধান নেই। এমন পরিস্থিতিতে যতটুকু করা সম্ভব, সেটি করছে কি না, তা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

গত সাড়ে তিন মাসে ব্যাংক ও জ্বালানি খাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, যে প্রক্রিয়ায় কাজ হচ্ছে, তাতে উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। তারপরও কোথায় যেন উদ্বেগটা কাটছে না। কেন কাটছে না, সেটি পরিষ্কার হওয়া দরকার। গণ-অভ্যুত্থানে যে উদ্দীপনা, উৎসাহ ও সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, সেটি কাজে লাগাতে হলে যোগ্যতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করতে হবে। দক্ষতার অভাবে, যোগ্যতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করতে না পারলে মানুষ হতাশাগ্রস্ত হবে।

সংস্কারের প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশে সবাই বলেছে সংস্কার লাগবে। একটি সংস্কার কতখানি লাগবে, কতখানি হবে, মানুষ কতটা ধৈর্য নিয়ে দেখবে, সংস্কারের গতি ও পরিধি কী হবে, তার সবকিছু নির্ভর করছে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকে কি থাকে না, তার ওপর। যদি অর্থনৈতিকভাবে মানুষ স্বস্তি না পায় এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে নিরাপদ বোধ না করে অর্থাৎ আর্থিক স্বস্তি ও জীবনের নিরাপত্তা ঠিক করা না গেলে সংস্কারের উচ্চাশা পূরণ হবে না।

দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে যে সম্পদ গড়ে তোলা হয়েছে, তা কেন বাজেয়াপ্ত করা হলো না, এই প্রশ্ন তুলেছেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের যে পাহাড় গড়ে তোলা হয়েছে, তা জনগণকে ফিরিয়ে দিতে না পারলে কিসের বিপ্লব হলো? এই সম্পদ কোথায় গেল? কেন আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকার এসব সম্পদ অধিগ্রহণ করল না? এ ছাড়া লুণ্ঠনকারী ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁদের ব্যাংকঋণ আছে, তা সমন্বয়ের জন্য তাঁদের সম্পত্তি কেন দ্রুত সময়ের মধ্যে অধিগ্রহণ করা হলো না? এমন পদক্ষেপের কথা শোনা গেলেও দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা গেলে মানুষের কর দেওয়ার আগ্রহ বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে র‌্যাপিডের চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বিগত সরকার বেপরোয়া অনেক অর্থনৈতিক নীতি নিয়েছে। তার ফলাফল এখন ভোগ করতে হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেলে মূল্যস্ফীতি বাড়ে। বাংলাদেশেও তা-ই হয়েছে। সামনের ছয় মাস খুবই জটিল। রিজার্ভে স্বস্তি না এলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

মূল্যস্ফীতি কমানোর ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে আস্থার ঘাটতি আছে বলে মন্তব্য করেন প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন। তিনি বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ছয় মাসের একটা অর্থনৈতিক পর্যালোচনা দিলে তা মানুষের মধ্যে আস্থা বাড়াতে সহায়তা করবে।

শওকত হোসেন আরও বলেন, পণ্যের জোগান দেয় বেসরকারি খাত। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু থেকেই বেসরকারি খাতের সঙ্গে যোগাযোগের ঘাটতি ছিল। শেখ বশিরউদ্দীনকে বাণিজ্য উপদেষ্টা করার মধ্য দিয়ে সেটি কাটানোর চেষ্টা করেছে সরকার।

বাজেট উন্মুক্ততা জরিপের ফলাফল তুলে ধরে আবু ইউসুফ বলেন, জাতীয় বাজেটের স্বচ্ছতায় ১০০ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ৩৭। বৈশ্বিক গড় ৪৫। এ ক্ষেত্রে ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। এ ছাড়া বাজেটে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে ১০০ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ১১। মূলত বাজেটের বিভিন্ন ধরনের প্রতিবেদন না করা এবং অনলাইনে সবার জন্য উন্মুক্ত না করার কারণে বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে। যদিও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে বাজেটের উন্মুক্ততার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।