খানা আয় ও ব্যয় জরিপে দারিদ্র্যের তথ্য–উপাত্ত নিয়ে প্রশ্ন

দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার কমে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে নেমেছে। ছয় বছর আগে ২০১৬ সালে এই হার ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। আর অতি দারিদ্র্যের হার এখন ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে, যা ছয় বছর আগে ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ।

জাতীয় পর্যায়ের মতো বিভাগওয়ারি দারিদ্র্যের চিত্রও পাল্টে গেছে। এখন আর সর্বোচ্চ দারিদ্র্যের হার রংপুরে নয়; বরিশাল বিভাগে। ইতিমধ্যে বরিশালে দারিদ্র্যের হার ২৬ দশমিক ৯ শতাংশ, যা রংপুরে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ।

গতকাল বুধবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২-এর চূড়ান্ত ফলাফলে এমন চিত্র উঠে এসেছে। ঢাকার আগারগাঁওয়ে বিবিএস মিলনায়তনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।

এদিকে অনুষ্ঠানে বক্তারা বিবিএসের প্রকাশিত দারিদ্র্যের হারের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের প্রশ্ন, দুই বছর ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে। এর প্রভাব দারিদ্র্যের হার কমে যাওয়ার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এই সময়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে গরিব ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের খাবার তালিকা ছোট হয়েছে। তাহলে ক্যালরি গ্রহণ বাড়ে কীভাবে? আবার শস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত বরিশালে দারিদ্র্য বাড়বে কেন?

দারিদ্র্যের চিত্র

সরকারি সংস্থা বিবিএস বলছে, দেশে এখন সর্বোচ্চ দারিদ্র্যের হার বরিশালে। সেখানে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ২৬ দশমিক ৯ শতাংশে উঠেছে। ২০১৬ সালে দক্ষিণাঞ্চলীয় এই বিভাগে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম দারিদ্র্যের হার এখন খুলনা বিভাগে। এই বিভাগে দারিদ্র্যের হার ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এত দিন সবচেয়ে দারিদ্র্যপ্রবণ বিভাগ হিসেবে পরিচিত ছিল রংপুর।

বিবিএস বলছে, গত ছয় বছরে ঢাকা, বরিশাল ও সিলেট বিভাগে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। দারিদ্র্যের হার এখন ঢাকায় ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ, চট্টগ্রামে ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ, রাজশাহীতে ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ, সিলেটে ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ, রংপুরে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ ও ময়মনসিংহে ২৪ দশমিক ২ শতাংশ হয়েছে।

দেশে বর্তমানে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ছয় বছর আগে ২০১৬ সালে ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। আর অতি দারিদ্র্যের হার এখন কমে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, যা ছয় বছর আগে ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ।

বিবিএস গত এপ্রিলে খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২-এর প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশ করে। প্রাথমিক ফলাফলের সঙ্গে চূড়ান্ত ফলাফলে দারিদ্র্যের হারে কোনো পরিবর্তন নেই। গতকালের অনুষ্ঠানে জরিপের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন বিবিএসের উপপরিচালক এবং খানার আয় ও ব্যয় জরিপ প্রকল্পের পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ।

যেখানে প্রশ্ন উঠেছে

অনুষ্ঠানে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি বেশি খুলনা জেলায়। সেখানে দারিদ্র্য বেশি বাড়ার কথা, অথচ দারিদ্র্য কমেছে। অন্যদিকে শস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত বরিশাল বিভাগে দারিদ্র্য সবচেয়ে বেশি। দেশের অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র ঢাকায়ও দারিদ্র্য বেড়েছে। কিন্তু কীভাবে দারিদ্র্য বাড়ল, তা দেখা উচিত।

হোসেন জিল্লুর রহমান আরও বলেন, দারিদ্র্য কমানোর প্রক্রিয়ায় দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য সুরক্ষা বেশি জরুরি। কারণ, হঠাৎ আসা যেকোনো ধরনের আঘাতে তাঁরা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারেন। তাঁদের সুরক্ষা দিতে পারলে দারিদ্র্য বিমোচন টেকসই হবে। এই অর্থনীতিবিদের মতে, মূল্যস্ফীতি সমন্বয় করে পরিবারের আয় দেখালে হয়তো দারিদ্র্য পরিস্থিতির আরেকটি চিত্র পাওয়া যেত।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করে। এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে দারিদ্র্যের হার এত কমল কীভাবে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে সাবেক অতিরিক্ত সচিব বিকাশ কিশোর দাস বলেন, ‘ছয় বছরের ব্যবধানে গড়ে জনপ্রতি ২০০ ক্যালরি গ্রহণ বেড়েছে। কিন্তু আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্নমধ্যবিত্তরা খাবারের তালিকা আঁটসাঁট করছেন। তাহলে ক্যালরি গ্রহণ বাড়ল কীভাবে?’

২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ৪৭ শতাংশের মতো দারিদ্র্য ছিল রংপুর বিভাগে। এখন তা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। অন্যদিকে বরিশালে দারিদ্র্য বেড়ে দেশের সর্বোচ্চ হয়েছে। এ নিয়ে একটি ব্যাখ্যা দেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম সচিব দীপংকর রায়। তিনি বলেন, হয়তো মঙ্গার অভিবাসন হয়েছে। নদী অববাহিকা ধরে তা বরিশালের দিকে গেছে। বরিশাল শস্যভান্ডার হিসেবে পরিচিত, সেখানে কেন দারিদ্র্য বাড়ল, তা-ও নীতিনির্ধারকেরা ভেবে দেখতে পারেন। তিনি আরও বলেন, বরিশালে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সবচেয়ে বেশি। সেখানে দারিদ্র্য কমার কথা। আবার কেউ বলতে পারেন, বেশি দারিদ্র্যের হার বলেই সেখানে সামাজিক নিরাপত্তা বেশি। এটি একটি আপেক্ষিক বিষয়।

বৈষম্য বেড়েছে

অন্যদিকে আয়বৈষম্য আগের চেয়ে বেড়েছে। বিবিএসের তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, ২০২২ সাল শেষে গিনি সহগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৪৯৯ পয়েন্ট। ২০১৬ সালে গিনি সহগ ছিল দশমিক ৪৮২ পয়েন্ট। সাধারণত দশমিক ৫০০ হলেই একটি দেশকে উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেদিক থেকে উচ্চ আয়বৈষম্য থেকে বাংলাদেশ খুব সামান্য দূরে আছে।

এ বিষয়ে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দারিদ্র্য কমার চেয়েও এখন বৈষম্য বৃদ্ধিই বেশি শক্তিশালী হয়ে দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে গরিব ৫০ শতাংশ মানুষের কাছে দেশের মোট আয়ের মাত্র ১৮ শতাংশ আছে। অন্যদিকে ধনী ৫ শতাংশের হাতে আছে মোট আয়ের ৩০ শতাংশ। উন্নয়ন বৈশিষ্ট্যের কারণে এ ধরনের বৈষম্য বাড়ছে।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব শাহনাজ আরেফিন, পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য কাউসার আহাম্মদ, বিবিএসের মহাপরিচালক মিজানুর রহমান প্রমুখ। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তিনি আসতে পারেননি। তবে তিনি একটি ভিডিও বার্তা দেন।