এক বছরের ব্যবধানে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ১৪ শতাংশ: বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন

  • গত বছর সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে উৎপাদন খাতে।

  • মোট বিদেশি বিনিয়োগের প্রায় ৪২ শতাংশ এসেছে এ খাতে।

দেশে বিদেশি বিনিয়োগ কমছে।গ্রাফিক্স: প্রথম আলো

দেশের চলমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে আরেকটি খারাপ খবর এল। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, দেশে বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে। বিশেষ করে নতুন বিনিয়োগ (ইক্যুইটি) তিন বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে কমছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল মঙ্গলবার ২০২৩ সালের প্রকৃত বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা গেছে, গত বছর প্রকৃত এফডিআই কমেছে প্রায় ১৪ শতাংশ, আর একই সময়ে নতুন বিনিয়োগ কমেছে ৩১ শতাংশ।

ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ডলার–সংকটের কারণে দুই বছর ধরে অনেক বিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে মুনাফা নিজ দেশে নিতে পারছে না। এর ফলে অনেকেই বিনিয়োগ করতে আগ্রহ হারাচ্ছেন। আবার অনেকে ব্যবসা সংকুচিত করে ফেলছেন। নতুন করে ব্যবসা সম্প্রসারণও কমিয়ে ফেলেছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। ডলার সমস্যার সমাধান না হলে বিদেশি বিনিয়োগে সুবাতাস আসবে না।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট ও দেশে ডলার–সংকটের কারণে বিদেশি বিনিয়োগ কম ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে ৩০০ কোটি ৪৪ লাখ ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। ২০২২ সালে এসেছিল ৩৪৮ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বা ৪৭ কোটি ৫৫ লাখ ডলার।

প্রকৃত বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার মানে হলো, গত এক বছরে দেশে যে পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, তার চেয়ে বেশি পরিমাণে মুনাফা নিয়ে গেছেন বিদেশিরা। সার্বিকভাবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশে পুঞ্জীভূত বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল প্রায় ২ হাজার ৫৫ কোটি ডলারের, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৫ শতাংশ কম।

গত বছর দেশে সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে পুনর্বিনিয়োগ থেকে, পরিমাণটা প্রায় ২২১ কোটি ডলার। তবে একদম নতুন বিনিয়োগের পরিমাণ খুবই কম, প্রায় সাড়ে ৭০ কোটি ডলার। মোট বিদেশি বিনিয়োগের সাড়ে ২৩ শতাংশ এসেছে ইক্যুইটি বা মূলধনি বিনিয়োগ হিসেবে। ২০২২ সালের তুলনায় মূলধনি বিনিয়োগ কমেছে ৩১ শতাংশ। এ ছাড়া আন্তকোম্পানি ঋণ হিসেবে সাড়ে ৮ কোটি ডলার বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে।

বেশি বিনিয়োগ উৎপাদন খাতে

গত বছর সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে উৎপাদন খাতে। মোট বিদেশি বিনিয়োগের প্রায় ৪২ শতাংশ এসেছে এ খাতে। উৎপাদন খাতের বিনিয়োগের বড় অংশই পুনর্বিনিয়োগ আকারে এসেছে। বিনিয়োগের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও পেট্রোলিয়াম খাত। যদিও নতুন বিনিয়োগ পাওয়ার দিক থেকে গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম খাত সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। গত বছর এ খাতে প্রায় ২৭ কোটি ডলারের মূলধন বিনিয়োগ এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিদেশি বিনিয়োগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হিস্যা রয়েছে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড) ও অর্থনৈতিক অঞ্চলের (ইজেড) বাইরের এলাকায়। প্রায় ৮৭ শতাংশ বিনিয়োগই ছিল ইপিজেড ও ইজেডের বাইরে। গত বছর ইপিজেডগুলোতে এসেছে মোট বিনিয়োগের ১৩ শতাংশ। দেশে বর্তমানে নয়টি ইপিজেড রয়েছে।

অন্যদিকে ইজেডে বিদেশি বিনিয়োগ আসার হার আরও হতাশাজনক। গত বছর এ ধরনের অঞ্চলে মাত্র ৮৯ লাখ ডলার বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, যা মোট বিদেশি বিনিয়োগের শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ।

গত বছর সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে যুক্তরাজ্য থেকে। দেশটি থেকে ৬১ কোটি ৩৯ লাখ ডলার বিনিয়োগ এসেছে। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাষ্ট্র। দেশ দুটি থেকে যথাক্রমে ৩৬ কোটি ও ৩১ কোটি ডলার বিনিয়োগ এসেছে।

বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফরেন চেম্বারের সাবেক সভাপতি নাসের এজাজ বিজয় প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়াটা বিস্ময়কর ছিল না। এর পেছনে প্রধানত তিনটি কারণ ছিল। প্রথমত নির্বাচনের কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে দ্বিধাবোধে ছিলেন। দ্বিতীয়ত বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিশ্বজুড়ে বিদেশি বিনিয়োগ কম ছিল। এ ছাড়া দেশের বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতির কঠোরতাও বিনিয়োগকারীদের নতুন বিনিয়োগ করার বিষয়ে সতর্ক অবস্থানে রেখেছিল।

নাসের এজাজ আরও বলেন, নির্বাচন হয়ে গেছে, আগামী পাঁচ বছর রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা থাকবে, তা দৃশ্যমান। বিনিয়োগকারীরা স্থানীয় কোম্পানি অধিগ্রহণসহ নতুন বিনিয়োগের সুযোগ খুঁজছেন। কিন্তু তাঁদের এই আকাঙ্ক্ষা প্রকৃত বিনিয়োগে রূপান্তর করতে ব্যবসার পরিবেশের উন্নতি করতে হবে, যেমন লজিস্টিক, শুল্ক ও করের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা যেন আরও ভালো অভিজ্ঞতা লাভ করেন, তা নিশ্চিত করা। প্রাণবন্ত পুঁজিবাজার ও সহায়ক বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থা বাংলাদেশের মতো দেশে এফডিআই আকর্ষণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বাজার ইতিমধ্যে প্রায় ৫০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছে গেছে; ২০৩১ সালের মধ্যে জিডিপি এক লাখ কোটি ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করার মাধ্যমে বিশ্বের নবম বৃহত্তম ভোক্তা অর্থনীতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে বাংলাদেশের।