সতর্কবার্তা উপেক্ষার ফল হচ্ছে চলমান অর্থনৈতিক সংকট: পিআরআই

আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই
ফাইল ছবি

অর্থনীতির সংকট আরও বেশি ঘনীভূত হয়েছে সংকট সমাধানের আশ্বাসে। কারণ, সংকট সমাধানে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, শুধু আশ্বাসই দেওয়া হয়েছে। এতে করে সংকট সমাধানে সরকারের যে সক্ষমতা ছিল, তা–ও কমে এসেছে বলে মন্তব্য করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)।

পিআরআই বলছে, সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গত এক বছরে যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, তা গত ৫০ বছরে নেওয়া হয়নি। ফলে ব্যাংক খাতে এখন পর্যাপ্ত অর্থ নেই। তাতে সরকারের অর্থনৈতিক সক্ষমতা কমে এসেছে। টাকার খোঁজে বাজেটে রাজস্ব আয়ের অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অনেক দিন ধরে অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা উপেক্ষা করার ফলে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করে পিআরআই।

আজ মঙ্গলবার রাজধানীর বনানীতে পিআরআইয়ের সম্মেলনকক্ষে বাজেট–পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এসব মন্তব্য করা হয়। বাজেট–পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন হলেও সামষ্টিক অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি ও আগামী দিনের করণীয় নিয়েও আলোচনা করা হয়। সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, অর্থনীতির সংকট উত্তরণে আগামী ছয় মাসের মধ্যে তিনটি পদক্ষেপ নিতে হবে। সেগুলো হচ্ছে রাজস্ব ঘাটতি কমিয়ে আনতে সরকারের ব্যয় সংকোচন, ডলারের সংকট কাটাতে বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহারের সীমা তুলে দেওয়া।

পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘যে কথাগুলো আমরা এখন বলছি, তা নতুন নয়। এক বছর ধরে এসব কথা বলে আসছি আমরা। অনেক দিন ধরে বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা উপেক্ষা করার ফলে অর্থনীতিতে সংকট আরও গভীর হয়েছে। তাতে সরকারের সক্ষমতা কমেছে। এখন রাতারাতি এই সক্ষমতা বাড়ানো যাবে না। কারণ, সরকারের ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে, কিন্তু আয় সেভাবে বাড়েনি। তাই প্রশাসনিক ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে। প্রয়োজনে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি কাটছাঁট করতে হবে। সেটি করা না হলে সামষ্টিক অর্থনীতির বিষয়গুলো ঠিক রাখা কঠিন হয়ে যাবে।’

আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, ব্যাংকের হাতে এখন টাকা কম। তাতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। গত এক বছরে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে যে পরিমাণ টাকা ঋণ নিয়েছে, তা গত পাঁচ দশকে নেওয়া হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, তারা টাকা ছাপিয়ে দিচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপালে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে ছাপানো টাকা বা ভল্টে থাকা টাকা যেটাই হোক, তা বাজারে ছাড়া হলে তাতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে।

সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক এম এ রাজ্জাক বলেন, অর্থনীতিতে চাপ আছে, তা সবাই মানছেন। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার বিষয়টি আরও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। দেশে ডলার–সংকট থাকা মানে সরকারের যে বৈদেশিক ঋণ আছে, তা পরিশোধে সমস্যা হবে। তা ছাড়া রিজার্ভ এখন যা আছে, তার চেয়ে কমলে মানুষের মধ্যে নেতিবাচক খবর ছড়াবে। এমন পরিস্থিতিতে মানুষের আত্মবিশ্বাসের চিড় ধরতে পারে। তাই রিজার্ভ পরিস্থিতি খুব বেশি খারাপ হওয়ার আগে সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বর্তমান বাস্তবতায় মূল্যস্ফীতি ৬–এর আশপাশে রাখা বড় চ্যালেঞ্জ হবে। এ ছাড়া সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাও একধরনের উচ্চাশা। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত ৫ দশমিক ৬ শতাংশ বাড়ানোর চিন্তা প্রায় অসম্ভব। বাণিজ্যঘাটতি উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে আছে। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্ত মেনে কর-জিডিপির অনুপাত দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে অন্তত চার লাখ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতে হবে, যেটা বর্তমান বাস্তবতায় কষ্টসাধ্য বলে মনে করে পিআরআই।