রাজস্ব খাতের সংস্কারে পদে পদে বিপত্তি

রাজস্ব খাতে সংস্কার এখন অপরিহার্য হয়ে গেছে। অর্থনীতির আকার গত এক দশকে যে হারে বেড়েছে, সেই হারে রাজস্ব আদায় বাড়েনি। কর দেওয়া সহজ হয়নি, করদাতার ভয় কাটেনি। আবার বছরের পর বছর কর অব্যাহতির সুবিধা নিয়ে দেশের বহু শিল্প খাতের বিকাশ হয়েছে। কর অব্যাহতির অপব্যবহারও হয়েছে। সংস্কারের উদ্যোগে আসে একশ্রেণির প্রভাবশালীর বাধা।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার অন্যতম শর্ত হলো রাজস্ব খাতে সংস্কার। কারণ, কর অব্যাহতির কারণে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আহরণ করা যাচ্ছে না। কর দেওয়ার ব্যবস্থা সহজ না করায় জেলা–উপজেলা পর্যন্ত করের ভিত্তি সম্প্রসারণ করা যাচ্ছে না। আবার যেকোনো সংস্কারের আগে সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে বাধা আসে।

দেশের কর–জিডিপি সবচেয়ে কম, এমন দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। আগামী তিন বছর পর বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হবে, তখন বিদেশি সহায়তা কমবে। তাতে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে আরও বেশি রাজস্ব আদায় করে খরচ জোগান দিতে হবে। কোভিড এবং চলমান বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের সময় বাজেটের অর্থ জোগান দিতে শুল্ক–কর আদায়ের বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

কর অব্যাহতি প্রত্যাহার কতটা সহজ

আইএমএফের রাজস্ব খাত সংস্কারের অন্যতম শর্ত কর অব্যাহতি কমানো। কারণ কর অব্যাহতির কারণে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করা যাচ্ছে না। বর্তমানে শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্প, বড় অবকাঠামো ও বিভিন্ন উৎপাদন খাতে কর অবকাশ সুবিধা রয়েছে। আবার কৃষি খাতের জন্যও রয়েছে কর ছাড় সুবিধা। এ ছাড়া আমদানি পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের পণ্যেও শুল্ক–কর ছাড় আছে। ভ্যাট হার ১৫ শতাংশের পরিবর্তে একাধিক হার রয়েছে। তাতে ভ্যাট ছাড়ের সুবিধা রয়েছে বেশির ভাগ সেবা ও পণ্যে।  

বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল একাধিকবার কর অব্যাহতি পর্যায়ক্রমে তুলে দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। বরং বাজেটে শুধু কর ছাড়ের ‘মেলা’ দেখা যায়। এবার আইএমএফ শর্ত হিসেবে কর অব্যাহতি তুলে নেওয়ার শর্ত দিয়েছে।  

আরও পড়ুন

এনবিআরের এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৯–২০ অর্থবছরে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকার কর অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ওই বছর কাঁচামাল, যন্ত্রাংশসহ পণ্য আমদানিতে ৪৬ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার শুল্ক–কর অব্যাহতি সুবিধা পান আমদানিকারকেরা। রপ্তানিমুখী শিল্প খাতের বন্ড সুবিধার আওতায় শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৫১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া ওই বছর আয়কর ও ভ্যাটে আরও ৫০ হাজার কোটি টাকার অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বছরটিতে এনবিআর যত টাকা রাজস্ব আদায় করেছে, এর চেয়ে বেশি কর অব্যাহতি দিয়েছে।

বাজেটে দেওয়া অর্থনীতির নীতি বিবৃতি অনুযায়ী, ২০১৯–২০ অর্থবছরে ৭ লাখ ৫২ হাজার ৪০০ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করা হয়। শুল্ক কর অব্যাহতি দেওয়ার কারণে ৪৪ শতাংশ বা ৩ লাখ ৩১ হাজার ৫৬ কোটি টাকার পণ্যে কর আরোপ করা যায়নি। এমনকি দেখা গেছে, একশ্রেণির আমদানিকারক মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে কম করের শ্রেণিভুক্ত পণ্য দেখিয়ে কর ফাঁকি দেন।

সব কর অব্যাহতি ঢালাওভাবে খারাপ, এমন নয়। কর অবকাশ–সুবিধা নিয়ে এ দেশে অনেক খাতের বিকাশ হয়েছে। অর্থনীতিতে এসব খাত ভূমিকা রাখছে। তৈরি পোশাকের তার একটি বড় উদাহরণ। আশির দশক থেকে বছরের পর বছর সুবিধা পাওয়া এ খাতে আর কত বছর এমন সুবিধা দেওয়া হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পোলট্রি খাত, কৃষি যন্ত্রপাতি—এসব খাতও কর অবকাশ সুবিধায় বেড়ে উঠেছে।

আরও পড়ুন

আবার কর ছাড়ের অপব্যবহারও হয়েছে। যেমন এক দশক আগে ২০১৩–১৪ অর্থবছরের মৎস্য চাষের আয়ে নামমাত্র ৩ শতাংশ কর ছিল। ওই সময় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের শতাধিক প্রার্থী নিজেদের হলফনামায় মৎস্য চাষি সেজেছেন। তাঁদের মধ্যে তৎকালীন মন্ত্রী, সংসদ সদস্যরাও ছিলেন। জানা যায়, তাঁদের অনেকের মৎস্য খাতে কোনো বিনিয়োগ ছিল না। মূলত তাঁরা কালোটাকা সাদা করতেই মৎস্য খাতে আয় দেখিয়েছেন। অন্যদিকে বিনা শুল্ক–করে বন্ড সুবিধায় পণ্য এনে খোলাবাজারে সেসব পণ্য বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনাও প্রায়ই ঘটে।

এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একবারে ঢালাওভাবে কর অব্যাহতি তুলে নেওয়া যাবে না। কারণ, সরকারের নীতি হলো সম্ভাবনাময় খাতকে কর ছাড় দিয়ে বিকাশে সহায়তা ও কর্মসংস্থান সৃস্টি করা। একটি শিল্প খাত দাঁড়িয়ে গেলে ওই খাত থেকে বেশি রাজস্ব আদায় করা সম্ভব।

করদাতার ভয় কমবে কীভাবে

শুধু আইএমএফ নয়; সবাই একমত—বাংলাদেশের করের জাল খুবই ছোট। এ কর জাল বাড়ানো দরকার। ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে ২৯ লাখ লোক সারা বছরের আয়–ব্যয়ের হিসাব দিয়ে আয়কর রিটার্ন জমা দেন। দেশে মাত্র ৮৪ লাখ ব্যক্তির কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) আছে। কেন মানুষ করজালে আসতে চান না? সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়, একবার করজালে ঢুকে গেলে কর কর্মকর্তাদের হয়রানির শিকার হতে হবে। টিআইএন নিলে বিপদে পড়তে হবে। কর অফিস মানেই যেন হয়রানির জায়গা।

আরও পড়ুন

২০১৯ সালে এনবিআরেরর ভ্যাট বিভাগ একটি করদাতা সন্তুষ্টি জরিপ করেছিল। বৃহৎ করদাতা ইউনিটে (এলটিইউ) দেশের বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ও তাদের মালিকদের যাবতীয় কর নথি থাকে। জরিপে উঠে এসেছিল ভ্যাট রিটার্ন দেওয়ার ক্ষেত্রে এসব বড় বড় প্রতিষ্ঠানের ২২ শতাংশকে ঘুষ দিতে হয়েছে। বড়দের যদি এ অবস্থা হয়; তাহলে ছোটদের কী হবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়।

এসব সমস্যার সমাধানে অনলাইনে ভ্যাট এবং আয়কর রিটার্ন জমা ও কর পরিশোধের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে গত কয়েক বছরে তেমন সাফল্য দেখা যায়নি। এ বছর মাত্র ২ লাখ ৪ হাজার করদাতা ঘরে বসে বার্ষিক আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন। অন্যদিকে অনলাইনে ভ্যাট রিটার্নের সুফল মিলছে না। উল্টো হয়রানির অভিযোগ করছেন ব্যবসায়ীরা।

তিন দশকে পুরো অটোমেশন হয়নি

করদাতা–কর কর্মকর্তাদের ‘দেখাদেখি’ বন্ধ করার সহজ উপায় হলো অটোমেশন। শুল্ক বিভাগের এসাইকুডা (স্বয়ংক্রিয় তথ্য–উপাত্ত ব্যবস্থাপনা) চালুর মাধ্যম এনবিআর সেই পথে প্রথম যাত্রা শুরু করে। গত তিন দশকে এসাইকুডা আরও হালনাগাদ হয়েছে। এ এসাইকুডার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের অনলাইন সেবা দেওয়া হয়। কিন্তু এখনো কাস্টমস হাউস, শুল্ক স্টেশনগুলোতে শুল্কায়ন প্রক্রিয়া মসৃণ হয়নি। চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে একধরনের সহায়তাকারী শ্রেণি গড়ে ওঠেছে। তাই পাসওয়ার্ড চুরি করে পণ্য খালাসের ঘটনাও ঘটেছে।

আরও পড়ুন

২০১৭ সালে নতুন ভ্যাট আইনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন, ভ্যাট রিটার্ন, ই–পেমেন্ট ব্যবস্থা চালু হয়। এর সুফল পুরোপুরি মিলছে না। এ ছাড়া ভ্যাট আদায়ে দেড় দশক ধরে দোকানে দোকানে ভ্যাটের মেশিন বসানোর উদ্যোগ এখনো আঁতুড়ঘরে। মাত্র চার হাজার প্রতিষ্ঠানে ভ্যাটের মেশিন বসেছে।

আয়কর বিভাগের সফলতা হলো টিআইএন নেওয়ার পুরো কার্যক্রম অনলাইনভিত্তিক করা হয়েছে। ২০১৩ সাল থেকে এ সেবা চালু আছে।

সংস্কারে বাধা আসে যেভাবে

রাজস্বসংক্রান্ত সংস্কার বা কর আরোপের সময় নানা পক্ষ থেকে বাধা আসে। দীর্ঘদিনের অনৈতিক চর্চা বা অবৈধ লেনদেনের সুবিধাভোগীরাই প্রথমে বাধা দেন। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, ২০১২ সালের ভ্যাট আইনটি নিয়ে দু–তিন বছর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা হয়। পরে ২০১৭ সালের জুলাই আইনটি চালুর ঠিক প্রাক্কালে ব্যবসায়ীদের চাপে তা দুই বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ নানা কারণে ভ্যাট আইন নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সমঝোতা করতে হয় নীতিনির্ধারকদের। অথচ ভ্যাট আইনটি চালু করা আইএমএফের বর্ধিত সহায়তা তহবিল (ইসিএফ) অর্থ ছাড়ের অন্যতম শর্ত ছিল। পরে ২০১৯ সালে একাধিক ভ্যাট হার করে আইনটি চালু করা হয়েছে।

কয়েক বছর আগে বাজেটে তৈরি পোশাক খাতে উৎসে কর দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। তখন পোশাকমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, সরকারের উচ্চ মহলে তদবির করে এ প্রস্তাবিত করহার তিনি কমিয়ে আনবেন। শেষপর্যন্ত তিনি কর কমিয়ে আনতে পেরেছিলেন।

এর আগে ১৯৯২ সালে আইএমএফের পরামর্শে প্রথমবারের মতো ভ্যাট আইন চালু করা হয়। ভ্যাট আইন চালু করতে গিয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বিরোধী দলের পাশাপাশি নিজের দলের বিরোধিতার মুখে পড়েন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভ্যাট আইন চালু করেন। রাজস্ব আদায় বাড়াতে ওই ভ্যাট আইন বেশ কার্যকর হয়।

এখন আইএমএফ শর্ত দিয়েছে নতুন শুল্ক আইন ও আয়কর আইন (সংশোধিত) চালুর। আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদনের প্রাক্কালে গত সপ্তাহে তাড়াহুড়া করে আয়কর আইনের খসড়া মন্ত্রিসভা বৈঠকে নীতিগত অনুমোদনও দেওয়া হয়। জাতীয় সংসদে উত্থাপিত শুল্ক আইনও আগামী বাজেট অধিবেশনে পাস করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। তবে আইন পাস করার পর তা চালু করতে বেশ কিছুদিন সময় লাগে। এ সময়ের মধ্যে আবার ভ্যাট আইনের মতো জটিলতা তৈরি হয় কি না, তা দেখার বিষয়।