আইএমএফ ঋণ অনুমোদনের পর একই পথে হাঁটছে বিশ্বব্যাংক-এডিবি

  • বাজেট সহায়তা দ্বিগুণ করতে পারে বিশ্বব্যাংক।

  • এপ্রিলে এডিবির বোর্ড সভায় ১০০ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন পেতে পারে।

  • এডিবির সঙ্গে থাকবে এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) ও জাপানের সাহায্য সংস্থা জাইকা।

বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণসুবিধা অনুমোদন দেওয়ার পর আরও দুটি বড় বহুপক্ষীয় ঋণদান সংস্থা বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) প্রতিশ্রুত অর্থসহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেয়, এখন সেদিকে দৃষ্টি ফিরছে।

বিশ্বব্যাংক আগেই বাংলাদেশকে সহায়তা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। এখন জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশের জন্য প্রতিশ্রুত বাজেট সহায়তা দ্বিগুণ করতে পারে বিশ্বব্যাংক। গত সপ্তাহে বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যাক্সেল ফন ট্রটসেন বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়ার পরই পরিস্থিতি বদলে গেছে।

চলতি ২০২৩ সালে সব মিলিয়ে ৫০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা পাওয়া নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে আলোচনা চলছিল। এখন এই বাজেট সহায়তার পরিমাণ ১০০ কোটি ডলারে উন্নীত হতে পারে। বিভিন্ন দায়িত্বশীল সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

আরও পড়ুন

আইএমএফের ঋণ অনুমোদন পাওয়ায় বিশ্বব্যাংকের অর্থ পাওয়াও সহজ হয়ে গেছে। কারণ, আইএমএফের যেসব সংস্কারের শর্তে বাংলাদেশ ঋণ নিতে রাজি হয়েছে, বিশ্বব্যাংকের সংস্কারের শর্তগুলো প্রায় একই রকম।

অর্থ মন্ত্রণালয়য়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও অন্য দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, বিশ্বব্যাংকের গ্রিন, রেজিলিয়েন্স, ইনক্লুসিভ, ডেভেলপমেন্ট (জিআরআইডি) বা গ্রিড কর্মসূচির আওতায় ২৫ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা পাওয়া নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে আলোচনা চলছিল। সেটি বাড়িয়ে এখন ৫০ কোটি ডলার চিন্তাভাবনা করছে বিশ্বব্যাংক। আগামী মার্চ মাসে বিশ্বব্যাংকের বোর্ড সভায় এই ঋণ প্রস্তাবে অনুমোদন দেওয়া হতে পারে।

ইআরডির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা চলছে। কোন কোন খাতে কীভাবে অর্থ খরচ হবে, তা নিয়ে শিগগিরই দর-কষাকষি চূড়ান্ত হবে।

একইভাবে চলতি অর্থবছরের জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উদ্যোগ নিতে আরও ২৫ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা নিয়ে শিগগিরই আলোচনা শুরু হবে। সেটিও এখন ৫০ কোটি ডলারে উন্নীত হতে যাচ্ছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এই ঋণ আগামী অর্থবছরের প্রথমার্ধে অর্থাৎ আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে অনুমোদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, গত ২১ থেকে ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যাক্সেল ফন ট্রটসেন বাংলাদেশ সফরে করেন। এই সফরকালে তিনি সরকারের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারক এবং বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বাজেট সহায়তার পরিমাণ বাড়াতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এরপর থেকে এ বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়। গ্রিড কর্মসূচির আওতায় ৫০ কোটি ডলার সহায়তা দেওয়া হলে তা দিয়ে কী ধরনের প্রকল্প নেওয়া হবে,  চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে তা চূড়ান্ত করতে হবে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ নিয়ে আইএমএফের মূল্যায়নটি বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের জন্যও জরুরি। আইএমএফ ঋণ অনুমোদন করায় অন্য উন্নয়ন সহযোগীরাও বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে। তাই বিশ্বব্যাংক বাজেট সহায়তার পরিমাণ বাড়াতে পারে।

সেলিম রায়হান আরও বলেন, আইএমএফ সংস্কার করার শর্তে ঋণ দিচ্ছে। প্রতিটি কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে সংস্কার কতটা হলো, তা মূল্যায়ন করা হবে। তখন কাঙ্ক্ষিত সংস্কার না হলে বিশ্বব্যাংক এবং এডিবি বেঁকে বসতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের অর্থ পেতে কিছু শর্ত নিয়ে এরই মধ্যে আলোচনা হয়েছে, যার সঙ্গে আইএমএফের শর্তের সঙ্গে মিল রয়েছে। যেমন ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন, শুল্ক আইন, আয়কর আইন পাস করা ইত্যাদি। এর মধ্যে শুল্ক আইন জাতীয় সংসদে পাসের জন্য উত্থাপন করা হয়েছে। গত সপ্তাহে নতুন আয়কর আইন মন্ত্রিসভা বৈঠকে নীতিগতভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কাজ করছে।

গত বছরের জুন মাসে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ইআরডি ১০০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা চেয়ে বিশ্বব্যাংককে চিঠি দিয়েছিল। এরপর কয়েক মাস এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে দু-তিন মাস ধরে এ নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনা চলছে। এই সময়ে বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইজার তিনবার বাংলাদেশ সফর করেন। প্রতিটি সফরে তিনি বাংলাদেশকে সহায়তা বৃদ্ধির আশ্বাস দেন।

আরও পড়ুন

বাজেট সহায়তার অর্থ খরচে সাধারণত কোনো খাতের উল্লেখ থাকে না। সরকার যেকোনো খাতে অর্থ খরচ করতে পারে। আইএমএফের ঋণ সেভাবেই খরচ করতে পারবে সরকার। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের বাজেট সহায়তার ক্ষেত্রে নিয়মটা ভিন্ন। এই সংস্থার অর্থ কোন কোন খাতে খরচ করা হবে, তা ঠিক করে দেয় বিশ্বব্যাংক। নানা শর্তও দেওয়া হয়।

বাজেট সহায়তা ছাড়াও আগামী তিন বছরে আইডিএ-২০ থেকে নমনীয় শর্তে ৬১৫ কোটি ডলার পাবে বাংলাদেশ।

এডিবির ১০০ কোটি ডলার

গত বছরের মে মাসে এডিবির কাছে ১০০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা চেয়ে চিঠি দেয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ। দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, সরকার সরাসরি অর্থ চাইলেও এডিবি তাতে রাজি হয়নি, বরং এডিবি কিছু সংস্কারের শর্ত দিয়েছে।

এসব শর্তের মধ্যে রয়েছে টেকসই অর্থনৈতিক সংস্কারের অংশ হিসেবে সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা, রাজস্ব আহরণে গতি বাড়ানো, প্রকল্পের কেনাকাটায় জবাবদিহি, স্বচ্ছতা আনাসহ অর্থনৈতিক সংস্কার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অভিযোজন ব্যবস্থাপনা উন্নত করা।

সূত্রগুলো বলছে, আগামী এপ্রিল মাসে এডিবির বোর্ড সভায় এই ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন পেতে পারে। সে ক্ষেত্রে আগামী জুন মাসের মধ্যেই পুরো অর্থ ছাড় করা হতে পারে। এডিবি অবশ্য পুরো অর্থ একা দেবে না। সহ-অর্থায়নকারী সংস্থা হিসেবে এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) ও জাপানের সাহায্য সংস্থা জাইকা এই সহায়তায় অংশ নেবে।