অর্থ পাচার রোধে সরাসরি অ্যাকশনে যেতে হবে

দৈনিক বণিকবার্তা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের যৌথ আয়োজনে দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে অতিথিদের হাতে সম্মেলনের প্রকাশনা। রোববার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে।ছবি : প্রথম আলো

সুশাসনে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের লন্ডন ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের (সোয়াস) অর্থনীতির অধ্যাপক মুশতাক খান। পাশাপাশি তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অর্থ পাচার রোধে সরাসরি অ্যাকশনে যেতে হবে।

রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে আজ রোববার ‘বিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে উন্নয়নের পথ অনুসন্ধান’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মুশতাক খান এ কথা বলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ এবং অর্থনীতি ও বাণিজ্যবিষয়ক বাংলা দৈনিক বণিক বার্তা যৌথভাবে ‘প্রথম উন্নয়ন অধ্যয়নবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামালের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, আর বিশেষ অতিথি ছিলেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ছিলেন অনুষ্ঠানের সঞ্চালক। বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ ও সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসরুর আরেফিন এতে স্বাগত বক্তব্য দেন।

সুশাসনের ঘাটতির কথা উল্লেখ করে মুশতাক খান বলেন, ‘একবার পতন শুরু হলে থামানো কঠিন। শ্রীলঙ্কার রাজাপক্ষে সরকার আমাদের সামনে বড় উদাহরণ। ১ ডলারে শ্রীলঙ্কায় এখন ৩০০ রুপি পাওয়া যায়, আর পাকিস্তানে পাওয়া যায় ২০০ রুপি। সুশাসনের অভাবে সংকটের মধ্যে পড়েছে শ্রীলঙ্কার মতো অনেক দেশ। ২০ বছর ধরে তারা বৈদেশিক ঋণ নিয়ে ইচ্ছেমতো ব্যয় করেছে এবং অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে।’

দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনে মামলা নিষ্পত্তির জন্য ২০ বছর ধরে কাউকে আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হয় না বলে নিজের পর্যবেক্ষণের কথা তুলে ধরেন মুশতাক খান। বলেন, দেশে দুর্নীতি হচ্ছে এবং দুর্নীতির মাধ্যমে আয় করা অর্থ পাচারও হচ্ছে। এখন পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে সরাসরি অ্যাকশনে যেতে হবে।

উদাহরণ দিয়ে মুশতাক খান বলেন, ‘দেখা যাচ্ছে ১০০ ডলারের রাস্তা তৈরির জন্য ২০০ ডলার ঋণ নেওয়া হয়েছে। ১০০ ডলারের রাস্তা দিয়ে ২০০ ডলারের আয় আসবে না। এমনকি ১০০ ডলারের রাস্তাও ঠিকভাবে তৈরি করা হয়নি। সবচেয়ে কম দামে কীভাবে সবচেয়ে মানসম্পন্ন অবকাঠামো তৈরি করা যায়, আমাদের এখন সেই কৌশল রপ্ত করতে হবে।’

বক্তব্য দেন অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ
ছবি: প্রথম আলো

অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, একদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ক্ষতিকর হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু বড় কোম্পানি চীন থেকে ব্যবসা সরিয়ে নিয়েছে ভিয়েতনামের মতো দেশে। সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশ এ সুবিধাটা নিতে পারেনি। অথচ বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম একই ধরনের অর্থনীতির দেশ ছিল। জনবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব নীতির জন্য ভিয়েতনাম এগিয়ে গেছে।

অর্থনৈতিক কূটনীতিতে শক্তিশালী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, দেশের ভেতরের রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের জন্য দেশের স্বার্থের বিষয়ে কোনো আপস করতে হয় না।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী
ছবি: প্রথম আলো

প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। বাংলাদেশও একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ তা মোকাবিলা করতে পেরেছে। বাংলাদেশ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। অর্থনীতি, সামাজিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব সূচকেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান মূলত সরকারের উন্নয়ন নিয়ে কথা বলেন। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাজেটের ১৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ বরাদ্দ, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হওয়া, সর্বজনীন পেনশন চালু ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেন তিনি। অর্থ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনে বাংলাদেশ ঠিক পথেই রয়েছে। এ ছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ সফলভাবেই হয়েছে। লক্ষ্য এখন স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া।

যুক্তরাজ্যের বাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী উপ-উপাচার্য জো ডিভাইন বলেন, সরকার যেসব সুযোগ-সুবিধা দেয়, সেগুলো মানুষের অধিকার হিসেবে না দিয়ে বরং আনুকূল্য হিসেবে দেয়। বাংলাদেশের মতো দেশের কিছু জেলায় দারিদ্র্য কমছে, পাশাপাশি কিছু জেলার মানুষ আরও দরিদ্রপ্রবণ হচ্ছে। স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা কিছু মানুষকে সুবিধা দেয় উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, এগুলো পায় সরকারি কর্মকর্তা, নির্দিষ্ট সম্প্রদায় বা চেয়ারম্যানের আস্থাভাজন লোকেরা।

সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন সুদের হার ও ডলারের দর বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, জোর করে কিছু না করে চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে অর্থনীতিকে চলতে দেওয়া উচিত। অফশোর ব্যাংকিংয়ে আমানত নেওয়ার সুযোগ তৈরি করায় এটি রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহের তৃতীয় বৃহত্তম উৎস হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন নেদারল্যান্ডসের হেগভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল স্টাডিজের রেক্টর আর আর গানঞ্জেভোর্ট এবং চীনের তিয়ানজিন ইউনিভার্সিটির ডিন অধ্যাপক জেং জং শিয়ান।