কমেছে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ, সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই

বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ কমেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিক শেষে বাংলাদেশের বকেয়া বিদেশি ঋণের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৯৬ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন বা ৯ হাজার ৬৫৪ কোটি ডলার। আগের ত্রৈমাসিক অর্থাৎ জুন মাস শেষে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৮ দশমিক ১০ বিলিয়ন বা ৯ হাজার ৮১০ কোটি ডলার।

সেই হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জুনের তুলনায় সেপ্টেম্বরে দেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন বা ১৫৫ কোটি ডলার কমেছে। দেখা যাচ্ছে, সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের ঋণই কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

দেখা যায়, সেপ্টেম্বর মাস শেষে বাংলাদেশ সরকারের বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৫ দশমিক ২৬ বিলিয়ন বা ৭ হাজার ৫২৬ কোটি ডলার; জুন মাস শেষে যা ছিল ৭৫ দশমিক ৮৫ বা ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সরকারের সরাসরি নেওয়া ঋণের পরিমাণ বাড়লেও সরকারি করপোরেশনগুলোর ঋণের পরিমাণ কমেছে। সেপ্টেম্বর শেষে সরকারের সরাসরি নেওয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৪ দশমিক ১৮ বিলিয়ন বা ৬ হাজার ৪১৮ কোটি ডলার; জুন মাস শেষে যা ছিল ৬৩ দশমিক ৭২ বিলিয়ন বা ৬ হাজার ৩৭২ কোটি ডলার।

সেপ্টেম্বরে সরকারি করপোরেশনগুলোর বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ দশমিক শূন্য ৮ বিলিয়ন বা ১ হাজার ১০৮ কোটি ডলার; জুন মাস শেষ যা ছিল ১২ দশমিক ১২ বিলিয়ন বা ১ হাজার ২১২ কোটি ডলার।

বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। জুন মাস শেষে যা ছিল ২২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার।

প্রথম আলোর আরেক সংবাদে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে বিদেশি সহায়তা ছাড় বেশ খানিকটা কমেছে। ইআরডি সূত্রে জানা যায়, জুলাই-অক্টোবর সময়ে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৫ কোটি ডলার কম ছাড় করেছে উন্নয়ন সহযোগীরা। এ সময়ে ১৬২ কোটি ডলার ছাড় হয়েছে। গতবার একই সময়ে ১৯৭ কোটি ডলার ছাড় হয়েছিল; যদিও এ সময়ে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছে। জুলাই-অক্টোবর সময়ে সুদাসল হিসেবে ১১০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে, গতবার একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ৭২ কোটি ডলার।

এ ছাড়া বিদেশি ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়া এবং ডলারে বিনিময়হার অস্থিতিশীল হয়ে যাওয়ার কারণে বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের পরিমাণ কমেছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট মানুষেরা। বিদেশি ঋণের সুদহার বাড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এখন ৭ শতাংশ। অথচ যখন দেশের ব্যাংকঋণের সুদহার ১৬-১৭ শতাংশ বা পরবর্তী সময়ে ৯ শতাংশ ছিল, তখন বিদেশি ঋণের সুদহার ছিল দেড় থেকে তিন শতাংশের মধ্যে। ফলে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা তখন বিপুল পরিমাণ বিদেশি ঋণ নিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তা কমতে শুরু করেছে।

এ ছাড়া দেড় বছর আগে ডলারের বিনিময়হার ছিল ৮৫ টাকা, এখন সেই ঋণ পরিশোধ করার সময় ডলারের বিনিময়হার দাঁড়িয়েছে ১১০ টাকা। সেই সঙ্গে ডলারের বাজারে এখনো অস্থিরতা থাকায় ভবিষ্যতে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে—এই আশঙ্কায় বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ কমেছে।

তথ্যানুসারে, চলতি বছরের মার্চ মাস শেষে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৫.৭৩ বিলিয়ন বা ৯ হাজার ৫৭৩ কোটি ডলার, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে যা ছিল ৯৬.৫২ বিলিয়ন বা ৯ হাজার ৬৫২ কোটি ডলার; যদিও বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২২ সাল শেষে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৭ দশমিক ১২ বিলিয়ন বা ৯ হাজার ৭১২ কোটি ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইআরডির তথ্যানুসারে, সেপ্টেম্বর শেষে বাংলাদেশের স্বল্পমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৩২ দশমিক ৮১ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ২৮১ কোটি ডলার আর দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৬৩ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন বা ৬ হাজার ৩৭৩ কোটি ডলার।

বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, নির্বাচন আসন্ন। সে জন্য সবাই একধরনের সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। এডিপি বাস্তবায়নে গতি কমে যাওয়ায় ঋণ ছাড় কমেছে; যদিও সরকারের সরাসরি নেওয়া ঋণের পরিমাণ এ প্রান্তিকে কমেনি। বেসরকারি খাতও এখন বিনিয়োগ ও সম্প্রসারণে যাচ্ছে না, তাই তাদের ঋণ নেওয়া কমেছে। তবে সরকারের স্বল্পমেয়াদি ঋণ কমেছে।

বিশ্লেষকেরা বলেন, বহুপক্ষীয় উৎস থেকে ঋণ পাওয়া গেলে ভালো, তার সুদের হার যেমন কম, তেমনি মেয়াদ বেশি। কিন্তু বাংলাদেশ এখন দ্বিপক্ষীয় উৎস থেকে বেশি ঋণ নিচ্ছে। সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় ২০২২ সালে মোট রপ্তানির ১১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় উৎস থেকে ঋণ বাড়লে এই সুদ পরিশোধের ব্যয় আরও বাড়বে বলেই ধারণা করা যায়।

বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন তথ্যানুসারে, ২০১০ সালের পর ১২ বছরে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ বেড়েছে আড়াই গুণের বেশি।

দেশের ঋণ নিয়ে একধরনের উদ্বেগ তৈরি হলেও সামগ্রিক ঋণ-জিডিপির অনুপাত এখনো ৪০ শতাংশের নিচে। তবে বিদেশি ঋণের অর্থে যেসব প্রকল্প হচ্ছে, সেখান থেকে বিদেশি মুদ্রা আয়ের তেমন সুযোগ নেই। সেই সঙ্গে টাকার যেভাবে অবমূল্যায়ন হচ্ছে, তাতে সরকারের ঋণ পরিশোধের ব্যয় বেড়ে যাবে। রাজস্ব আয় আনুপাতিক হারে না বাড়লে ঋণ পরিশোধ নিয়ে শঙ্কা থেকে যায় বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।