পদে পদে স্ট্যাম্প ডিউটি বাড়ল

বিক্রয় দলিল, হলফনামা, নকল, দানপত্র, হেবা বা দানের ঘোষণা, তালাকসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে স্ট্যাম্প ডিউটি বৃদ্ধি পাওয়ায় সেবাগ্রহীতার খরচ বাড়বে।

চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছর থেকে স্ট্যাম্প ডিউটিতে মানুষকে পুড়তে হবে। কারণ, গত ১ জুলাই থেকে সব ধরনের স্ট্যাম্প ডিউটি পাঁচ গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তাই বিক্রয় দলিল, হলফনামা, নকল, দানপত্র, হেবা বা দানের ঘোষণা, তালাকসহ বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রমে স্ট্যাম্প ডিউটি ৫০ থেকে ৫০০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ায় সেবাগ্রহীতাদের খরচ বাড়বে। এ ধরনের সেবা গ্রহণে ধনী-গরিব সবাইকে একই রকম শুল্ক দিতে হয়। সে জন্য উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে সাধারণ মানুষের ওপর একধরনের চাপ সৃষ্টি হবে।

চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা সময় স্ট্যাম্প ডিউটির পরিমাণ বাড়ানোর প্রস্তাব দেন অর্থমন্ত্রী। অর্থ বিল ২০২২–এ এই প্রস্তাব আনেন তিনি। পরে অর্থ বিল পাসের সময় ওই সব প্রস্তাব জাতীয় সংসদে পাস হয়। আর অর্থবছরের প্রথম দিন, অর্থাৎ ১ জুলাই থেকে নতুন স্ট্যাম্প ডিউটি কার্যকর হয়। বছরজুড়ে নন–জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প বিক্রির মাধ্যমে সরকার এই অর্থ আদায় করে। সাধারণত ভেন্ডররা স্ট্যাম্প কেনার সময়ই স্ট্যাম্প ডিউটি দিয়ে থাকেন।

স্ট্যাম্প ডিউটি বাড়ানোর ফলে মানুষের মাঝে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বাড়তে পারে। নন–জুডিশিয়াল দলিল কিনতে অনাগ্রহ দেখা দিতে পারে।
মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, সাবেক সচিব, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ জাহাঙ্গীর শাহ, ঢাকা

বর্তমানে ২২ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে স্ট্যাম্পের প্রয়োজন নয়। সেখানে নির্ধারিত হারে শুল্ক দিতে হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে স্ট্যাম্প ডিউটির সীমা নির্ধারণ করে সেবাগ্রহীতাদের স্বস্তিও দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ ২০১২ সালে স্ট্যাম্প ডিউটি বাড়ানো হয়েছিল। প্রায় ১০ বছর পর আবার তা বাড়ানো হলো। এটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বহির্ভূত কর। চলতি অর্থবছরে সরকার এই খাত থেকে ১৩ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করেছে।

এ বিষয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (আইআরডি) সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, ধনী-গরিব সবাইকে সমান হারে স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হয়। স্ট্যাম্প ডিউটি বাড়ানোর ফলে গরিব ও মধ্যবিত্তের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। কারণ, তাদেরও নানা কারণে নন–জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ব্যবহার করতে হয়। তাই স্ট্যাম্প ডিউটি বাড়ানোর কারণে মানুষের মাঝে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বাড়তে পারে। নন–জুডিশিয়াল দলিল কিনতে অনাগ্রহ দেখা দিতে পারে। তিনি আরও বলেন, জমি কেনার সময় দামের একটা অংশ স্ট্যাম্প ডিউটি হিসেবে দিতে হয়। কিন্তু স্ট্যাম্প ডিউটির পরিমাণ বৃদ্ধি করায় অনেকেই প্রকৃত দাম লুকিয়ে রাখতে পারেন।

কোন সেবায় কত স্ট্যাম্প ডিউটি

এবার দেখা যাক, কোন কোন সেবায় কত হারে স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হবে। হলফনামা দলিলের জন্য আগে ২০০ টাকা শুল্ক দিতে হতো। এখন তা বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করা হয়েছে। সম্পদ হেবা বা দানের ঘোষণার ক্ষেত্রে আগে ছিল ২০০ টাকা। তা বাড়িয়ে এখন ১ হাজার টাকা করা হয়েছ। বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রেও একধরনের দলিল করতে হয়। এ ধরনের বিবাহবিচ্ছেদ দলিলে স্ট্যাম্প ডিউটি ৫০০ টাকা থেকে চার গুণ বাড়িয়ে দুই হাজার টাকা করা হয়েছে। ফলে বিবাহবিচ্ছেদ আরও খরচে হয়ে গেল।

জমি বা সম্পদের বণ্টননামার জন্য দলিলের প্রয়োজন হয়। আগে ৫০ টাকা খরচ করলেই হতো। এখন থেকে ১০০ টাকা খরচ করতে হবে। আবার আপনি কোনো চুক্তি বা প্রতিশ্রুতি বাতিল করবেন, তাহলে ২০০ টাকার পরিবর্তে ৫০০ টাকা স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হবে।

জমিজমা বা যেকোনো সম্পদ বিক্রি করলে লেনদেন মূল্যের বিপরীতে আগে দেড় শতাংশ স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হতো। এখন সেই হার
ঠিকই আছে, তবে এবার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আর তা হলো দুই কোটি টাকা। বিনিময় চুক্তির জন্য স্ট্যাম্প ডিউটি ১ শতাংশ ঠিক রাখা হলেও সর্বোচ্চ সীমা ১ কোটি টাকা করা হয়েছে।

এ ছাড়া যেকোনো ধরনের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেওয়ার দলিল করার সময় ব্যবহৃত স্ট্যাম্পের ডিউটি বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে নানা ধরনের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেওয়ার ক্ষেত্রে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকার স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হয়। এখন থেকে বিদ্যমান স্ট্যাম্প ডিউটির সঙ্গে আরও ৩০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা বাড়তি যোগ হবে।

আপনার কোনো সম্পদ বন্ধক দেওয়া আছে। এই বন্ধকি সম্পদ অবমুক্ত করতে হলেও দলিল করতে হয়। সেই দলিল করার খরচও বাড়ল। আগে স্ট্যাম্প ডিউটি ছিল ৩০০ টাকা, এখন তা করা হয়েছে ৫০০ টাকা। একইভাবে ‘না’ দাবিনামার ক্ষেত্রে স্ট্যাম্প ডিউটি ২০০ থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করা হয়েছে।

ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা প্রয়োজনে (পুকুর বা জলাশয়, জমিজমা ইত্যাদি) বিভিন্ন ধরনের সম্পদ লিজ নিয়ে থাকেন। এসব লিজ কার্যক্রমের জন্য দলিল করতে হয়। এই দলিল করার সময় স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হয়। সেখানে এবার খরচ বাড়ানো হয়েছে। আগে দলিলমূল্যের ওপর দেড় শতাংশ হারে স্ট্যাম্প ডিউটি বসতো। ফলে দলিলমূল্য কম দেখানোর অভিযোগ আছে। প্রকৃত দলিলমূল্য যাতে দেখানো হয়, সে জন্য স্ট্যাম্প ডিউটির হার পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। যেমন লিজের মেয়াদ ৫ থেকে ২৫ বছরের হলে দলিলমূল্যে ডিউটি বসবে দশমিক ২ শতাংশ, কিন্তু মোট পরিমাণ এক কোটি টাকার বেশি হবে না। লিজের মেয়াদ ২৫ বছরের বেশি বা স্থায়ী হলে দশমিক ৩ শতাংশ ডিউটি প্রযোজ্য হবে। তবে তা পরিমাণে ২ কোটি টাকার বেশি হবে না। অন্য ক্ষেত্রে স্ট্যাম্প ডিউটি হবে দশমিক ৪ শতাংশ, কিন্তু ৩ কোটি টাকার বেশি হবে না।