রাজস্ব আদায় বাড়াতে যা করতে হবে বাংলাদেশকে

জ্যঁ পেম

উন্নয়নের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। টানা কয়েক দশক ধরে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্যের পর সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ যে জনসংখ্যাগত সুবিধা এত দিন ভোগ করেছে, তা আগামী এক দশকে ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসবে। এই প্রেক্ষাপটে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পথে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশের নিম্ন রাজস্ব আহরণ।

গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত কমে ৬ দশমিক ৭ শতাংশে নেমেছে। অথচ প্রয়োজনীয় উন্নয়ন কার্যক্রম টিকিয়ে রাখতে এ হার কমপক্ষে ১৫ শতাংশ হওয়া দরকার। অর্থাৎ বর্তমানে বাংলাদেশ প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় অর্ধেক রাজস্ব সংগ্রহ করছে। রাজস্ব আহরণ এত কম হলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই বাস্তবতায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বহুমুখীকরণ ও টেকসই কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশকে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়াতে হবে।

প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আদায় এত কম কেন? দেখা যায়, করের হার অনেক ক্ষেত্রে সমজাতীয় দেশগুলোর সমান, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি। তবে মূল সমস্যা করের হার নয়; সমস্যা হলো করব্যবস্থার জটিলতা ও বিকৃতি। দেশে একই ধরনের করের একাধিক হার রয়েছে। পাশাপাশি ভ্যাট ও আয়কর আদায়ে ব্যাপক ছাড় দেওয়া হয়। উদ্বেগজনক বিষয় হলো, করছাড়ের পরিমাণ প্রায় মোট সংগৃহীত করের সমান। এটি একদিকে বড় ধরনের কাঠামোগত বিকৃতি তৈরি করছে, অন্যদিকে দুর্নীতির সুযোগ বাড়াচ্ছে।

‘বর্তমানে বাংলাদেশ প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় অর্ধেক রাজস্ব সংগ্রহ করছে। রাজস্ব আহরণ এত কম হলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।’

ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান—উভয় ক্ষেত্রেই করদাতার সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। খুব কমসংখ্যক মানুষ ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নিয়মিত কর পরিশোধ করে। অন্যদিকে বাণিজ্যসংক্রান্ত শুল্কের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা এত বেশি যে অনেক ক্ষেত্রে তা বাণিজ্যকে নিরুৎসাহিত করে। অথচ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বাণিজ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চ শুল্ক ও সম্পূরক শুল্ক রপ্তানিবিরোধী পক্ষপাত তৈরি করতে পারে, যা দীর্ঘ মেয়াদে প্রবৃদ্ধির জন্য ক্ষতিকর।

এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের করকাঠামোর সাহসী ও সামগ্রিক সংস্কার প্রয়োজন। নীতিগত পরিবর্তনের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন ও সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে জোর দিতে হবে। করছাড় যৌক্তিকীকরণ হওয়া উচিত অগ্রাধিকার। ভ্যাট ও আয়করব্যবস্থাকে আরও কার্যকর ও দক্ষ করতে হবে। একই সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে ধাপে ধাপে শুল্ক কমানো জরুরি।

**কর-জিডিপি অনুপাত নেমে এসেছে ৬.৭ শতাংশে। **করছাড়ের পরিমাণ প্রায় সংগৃহীত করের সমান। **শুল্কনির্ভরতা বাণিজ্য ও রপ্তানিকে নিরুৎসাহিত করছে। **এনবিআরের পুনর্গঠন রাজস্ব ব্যবস্থার জন্য বড় সুযোগ।

করছাড় যৌক্তিকীকরণে সরকার যে কাঠামো তৈরি করেছে, তা সম্পূর্ণ ও ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এই কাঠামোর লক্ষ্য যেন কেবল প্রশাসনিক নয়, বাস্তব রাজস্ব আহরণ বাড়ানো হয়। করছাড়ের বিষয়টি সংসদের অনুমোদনের আওতায় আনা প্রয়োজন। পাশাপাশি করছাড় থেকে কী ধরনের সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে, তার নিয়মিত মূল্যায়ন থাকতে হবে। প্রতিবছর কী পরিমাণ করছাড় দেওয়া হচ্ছে, তা প্রকাশ করাও জরুরি। এতে করব্যবস্থায় স্বচ্ছতা বাড়বে এবং কোন ক্ষেত্রে করছাড় প্রত্যাহার করা প্রয়োজন, তা স্পষ্ট হবে।

বাংলাদেশে দ্বৈত করের সমস্যাও রয়েছে। এই সমস্যা দূর করতে হবে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো যে পরিমাণ প্রকৃত মূল্য সংযোজন করে, শুধু তার ওপরই কর দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার। করপোরেট করের ক্ষেত্রেও একই ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। বর্তমানে করপোরেট করহার ২০ থেকে ৪৫ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। এত বড় ব্যবধান যুক্তিসংগত নয়। বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া করপোরেট করহার একীভূত করা উচিত। পুঁজি আয়ের ওপর করহার আরও সামঞ্জস্যপূর্ণ করা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে।

ব্যক্তিগত আয়করব্যবস্থাকে আরও অনুক্রমিক করার সুযোগ রয়েছে। বিদ্যমান ছাড় ও অব্যাহতি পুনর্বিন্যাস করা যেতে পারে। মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে সম্পদ কর বাংলাদেশের রাজস্বের নতুন উৎস হতে পারে। তবে এর জন্য বাজারভিত্তিক ও স্বচ্ছ মূল্যায়নপ্রক্রিয়া অপরিহার্য। বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় প্রশাসনিক সক্ষমতাও বাড়াতে হবে।

বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্বার্থে ধাপে ধাপে শুল্ক ও সম্পূরক শুল্ক কমানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাণিজ্য উন্নয়ন কাঠামোর আধুনিকায়ন ও রপ্তানিবিরোধী পক্ষপাত কমাতে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয় শুল্কনীতি প্রণয়ন করেছে। এই নীতি বাস্তবায়নে শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক ও অশুল্ক বাধা কমাতে হবে। ধাপে ধাপে অগ্রসর হলে রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় চাপ তুলনামূলকভাবে কম থাকবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বর্তমানে পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে; নীতি বিভাগ ও প্রশাসন বিভাগ আলাদা করা হচ্ছে। এনবিআর পুনর্গঠনের উদ্যোগ বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থাকে আমূল বদলে দেওয়ার একটি বড় সুযোগ। এই সংস্কারের সঙ্গে করকাঠামোর সংস্কারের সামঞ্জস্য থাকা প্রয়োজন। করনীতি প্রণয়ন ও কর প্রশাসন আলাদা হলে দায়িত্ব বণ্টন স্পষ্ট হবে এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব কমবে। এর জন্য গেজেট প্রজ্ঞাপন জারি করে রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ গঠন এবং আলাদা সচিব নিয়োগ করা জরুরি। পাশাপাশি নতুন জনবল, স্পষ্ট দায়িত্ব কাঠামো, আচরণবিধি, অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ও দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে।

পাশাপাশি কর প্রশাসনে ডিজিটাল অটোমেশনের পরিধি বাড়াতে হবে। তাহলে সমন্বিত কর প্রশাসন ব্যবস্থার পূর্ণ অটোমেশন কর পরিপালন, দক্ষতা ও জবাবদিহি বাড়বে; মানবিক যোগাযোগ কমবে এবং দুর্নীতির সুযোগ সীমিত হবে। প্রত্যেক করদাতার জন্য একক ও অনন্য করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর কার্যকরভাবে চালু করা দরকার।

অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বাড়ানোর পথ সহজ নয়। তবে জনগণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশকে এ পথেই এগোতে হবে।

জ্যঁ পেম: বিশ্বব্যাংকের ভুটান ও বাংলাদেশবিষয়ক বিভাগের পরিচালক। তাঁর লেখাটি সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের ব্লগে প্রকাশিত হয়