মূল্যস্ফীতির চাপে নিম্ন আয়ের মানুষ

১৫ মাস ধরে দেশে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ঘরে। টানা দুই মাস ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি।

রাজধানীর শেওড়াপাড়ার একটি বাসা দেখভালের কাজ করেন ৬০ বছর বয়সী শহীদ খান। তাঁর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বর্তমানে আয় করেন তিনজন। স্ত্রী অন্যের বাসায় কাজ করেন, আর ছেলে একটি পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মী। সব মিলিয়ে তাঁদের মাসিক আয় ২৮ হাজার টাকা।

শেওড়াপাড়াতেই দুই বেডরুমের একটি বাসায় থাকে শহীদ খানের সাত সদস্যের পরিবার। প্রতি মাসে বাসাভাড়া, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির বিল বাবদ প্রায় ১৫ হাজার টাকা এবং যাতায়াত ও হাতখরচে যায় হাজার তিনেক। এদিকে শহীদ খানের হৃদ্‌রোগ ও হাঁপানির সমস্যা, আর স্ত্রীর কিডনিজনিত সমস্যা আছে। তাতে মাসে হাজার চারেক টাকার ওষুধ লাগে। গ্রামের বাড়িতে বৃদ্ধ মা–বাবার জন্য মাসে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা করে পাঠাতে হয়। এরপর নিজেদের খাবারের জন্য চার হাজার টাকার মতো অবশিষ্ট থাকে। তাই খরচ সামলাতে দোকানে নিয়মিত বাকি খান তাঁরা।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ লাগবে। বাজেটে কিছু ভূমিকা নেওয়া যায়। আমদানি পণ্যে পাঁচ ধরনের শুল্ক ও কর আরোপ করা হয়। এর ফলে বাজেটে শুল্ক ও করছাড় দেওয়া হলে কিছু নিত্যপণ্যের দাম কমতে পারে।
মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি

শহীদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জিনিসপত্রের দাম এত বাড়ছে যে কোনোমতে খেয়ে না–খেয়ে টিকে আছি। অনেকটা নিয়মিত খরচায় নানাভাবে ঠেক দিয়ে দম বন্ধ অবস্থায় চলছি। বছর দুয়েক আগে এক কেজি ইলিশ কিনে খেয়েছিলাম। আর কোরবানির সময় ছাড়া গরুর মাংস খাওয়ার সুযোগ হয় না।’

শহীদ খানের মতো কম আয়ের মানুষেরা দীর্ঘদিন ধরেই কমবেশি এ রকম চাপে আছেন। এর প্রধান কারণ নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য। নিত্যপণ্যের দাম যে হারে বাড়ছে, সেই হারে বাড়ছে না আয়। তাতে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ছে। সে জন্য কেউ সঞ্চয়, কেউ ব্যাংকের স্থায়ী আমানত ভেঙে খাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা টাকা মেয়াদপূর্তির আগেই তুলে নিচ্ছেন।

গত ১৫ মাস ধরে দেশে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ঘরে। টানা দুই মাস ধরে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দেরিতে হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। যদিও উচ্চ মূল্যস্ফীতি বাগে আসার কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না।

এমন প্রেক্ষাপটে আগামীকাল ৬ জুন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপন করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। নতুন বাজেটের আকার হচ্ছে প্রায় আট লাখ কোটি টাকা।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, আগামী বাজেটে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই হবে সরকারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। এ জন্য একগুচ্ছ সমন্বিত নীতি নিতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তায় জোর দেওয়ার পাশাপাশি শহরাঞ্চলের শ্রমিকদের জন্য রেশনিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতির কারণে যেহেতু বাচ্চাদের পুষ্টির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, সেহেতু তাদের জন্য স্কুলে বিনা মূল্যে খাদ্য কর্মসূচি চালু করা দরকার।

পদে পদে মূল্যস্ফীতির চাপ

মিরপুরের একটি তৈরি পোশাক কারখানার কোয়ালিটি ইনচার্জ শামসুল হক ওভারটাইমসহ মাসে আয় করেন ২৫ হাজার টাকার মতো। এর বড় অংশই বাসাভাড়া ও ছেলের লেখাপড়ার পেছনে খরচ হয়।

শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘খাওয়ার খরচ বাদে অন্য কোথাও খরচ কমানোর উপায় নেই। মুদিদোকান থেকে নিয়মিত বাকিতে পণ্য আনতে হয়। মাঝেমধ্যে পরিচিত কারও বা সমিতি থেকে ঋণ করতে হয়। এক ঋণের দায় মেটাতে আরেক জায়গা থেকে ঋণ করতে হয়। এভাবে লাখ টাকার মতো ঋণ হয়ে গেছে।’

তিন বছর ধরে মোটা চাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালের জুনে যে মোটা চালের প্রতি কেজির দাম ছিল ৪৫-৪৮ টাকা, তা বেড়ে এখন ৪৮-৫২ টাকা হয়েছে। এই সময়ে সয়াবিন তেলের দাম ১২ শতাংশ, প্যাকেটজাত আটা ৬৬ শতাংশ, চিনি ৭৫ শতাংশ ও মোটা দানার মসুর ডালের দাম বেড়েছে ৪৩ শতাংশ।

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্যানুযায়ী, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের চেয়ে বাংলাদেশে চালের দাম বেশি। এ ছাড়া দেশে এখন চিনির দাম যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোর চেয়েও বেশি। গত সাড়ে ৫ বছরে চিনির দাম ১৫২ শতাংশ বেড়েছে, এখন চিনির কেজি ১৩০ টাকা। অন্যদিকে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি কেজি চিনি ইইউতে ৩৯ টাকা ও যুক্তরাষ্ট্রে ৯৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

জানতে চাইলে সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ লাগবে। বাজেটে কিছু ভূমিকা নেওয়া যায়। আমদানি পণ্যে পাঁচ ধরনের শুল্ক ও কর আরোপ করা হয়। এর ফলে বাজেটে শুল্ক ও করছাড় দেওয়া হলে কিছু নিত্যপণ্যের দাম কমতে পারে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজার ব্যবস্থাপনা ও সরবরাহব্যবস্থা ঠিক রাখার পাশাপাশি কৃষির উৎপাদনশীলতায় জোর দিতে হবে।