আরও ৪ প্রকল্প বাদ দিতে চায় বাংলাদেশ

ইতিমধ্যে ৮টি প্রকল্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। এরপর এলওসির প্রকল্প সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০। সেখান থেকে আরও ৪টি বাদ দিতে অনুরোধ করেছে সরকার।

ভারতীয় ঋণে প্রকল্প গ্রহণের আগ্রহ কমছে বাংলাদেশের। যে কারণে গত তিন বছরে ভারতের এক্সিম ব্যাংকের লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) বা গুচ্ছ ঋণ থেকে আটটি প্রকল্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। আরও চারটি প্রকল্প প্রত্যাহারের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। মূলত ভারতীয় ঋণের কঠিন শর্ত, ঠিকাদারদের বেশি দাম চাওয়া, প্রতি পদে পদে সম্মতি নেওয়াসহ নানা কারণে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রকল্প প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। আগে প্রত্যাহার করে নেওয়া আট প্রকল্পে সব মিলিয়ে ১১৩ কোটি ডলার বিনিয়োগের কথা ছিল। নতুন করে আরও যে চারটি প্রকল্প প্রত্যাহারের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে, সেগুলোতে বরাদ্দ আছে ১০১ কোটি ডলার। গত এক যুগে ভারতের তিনটি এলওসির মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রায় ৭৫০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি করেছে। এর মধ্যে মাত্র ১৫০ কোটি ডলারের মতো ছাড় করা হয়েছে। এসব ঋণে সব মিলিয়ে ৪০টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত এক যুগে ভারতীয় ঋণের ছাড় ও প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বেশ কম। বাংলাদেশ ও ভারত—দুই দিকেই আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা ও জটিলতা আছে। নানা নিয়মকানুনের কারণে উভয় পক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সময় লাগে। আবার ঠিকাদারেরা যে দর দেন, তা অনেক বেশি। যেহেতু ভারতীয় ঠিকাদারদেরই কাজ দিতে হবে, তাই বেশি দর দিলেও আমরা তা নিতে বাধ্য। তাতে একধরনের জিম্মি হয়ে যাই।’

জাহিদ হোসেন আরও বলেন, ‘ভারত থেকে ৭৫ শতাংশ কেনাকাটা করে ভৌত প্রকল্প বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব। সার্বিকভাবে ভারতীয় এলওসির অভিজ্ঞতা ভালো নয়। তাই এলওসি থেকে প্রকল্প প্রত্যাহার বা বেরিয়ে আসাকে সমর্থন করি।’

প্রকল্প প্রত্যাহারের প্রস্তাব

ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, এলওসির তালিকা থেকে আরও চারটি প্রকল্প বাদ দিতে একটি প্রস্তাব ভারতের এক্সিম ব্যাংকের কাছে গত ডিসেম্বরে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এখনো এক্সিম ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। প্রকল্পগুলো হলো বাংলাদেশ রেলওয়ের সৈয়দপুরে নতুন ওয়ার্কশপ নির্মাণ (৭ কোটি ডলার); প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরী স্থাপন (সাড়ে ১৬ কোটি ডলার); নৌ মন্ত্রণালয়ের চট্টগ্রাম বে কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ (৪০ কোটি ডলার) এবং সৈয়দপুর বিমানবন্দর আধুনিকায়ন প্রকল্প (সাড়ে ৩৭ কোটি ডলার)। চারটিই ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের প্রকল্প।

এক্সিম ব্যাংকের শর্ত অনুসারে, প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ কেনাকাটাই ভারত থেকে করতে হবে। তবে কর্মকর্তারা মনে করেন, এই চার প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে ভারতীয় ঠিকাদারকে ইট-বালু, রড-সিমেন্ট—সবই ভারত থেকে আনতে হবে।

সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপ প্রকল্প সম্পর্কে বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী মুহাম্মদ কুদরত-ই-খুদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক বছর আগে প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই ও নির্মাণ নিয়ে একটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। ভারতীয় ঋণে প্রকল্পটি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশন থেকে বলা হয়, আগে সম্ভাব্যতা যাচাই করে পরে প্রকল্প প্রস্তাব পাঠাতে হবে। এ ধরনের প্রকল্প নেওয়ার মতো পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল নেই। এসব কারণে প্রকল্পটি ভারতীয় ঋণ থেকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হতে পারে। আমাদের এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি।’

কোন প্রকল্প কবে প্রত্যাহার

প্রতিটি এলওসির আওতায় একাধিক প্রকল্প নেওয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী, প্রকল্প প্রস্তাব প্রথমে এক্সিম ব্যাংকের কাছে পাঠানো হয়। তাদের সম্মতি পাওয়া গেলে তা চূড়ান্ত তালিকাভুক্ত করা হয়। সেই অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু নানা জটিলতায় সেই তালিকা থেকে কিছু প্রকল্প প্রত্যাহার করে নিয়েছে বাংলাদেশ।

সর্বশেষ গত মে মাসে দুটি প্রকল্প প্রত্যাহার করা হয়। গত ৯ মে সরকারি মুঠোফোন প্রতিষ্ঠান টেলিটকের সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করার প্রকল্প বাদ দেওয়া হয়। এতে তিন কোটি ডলার দেওয়ার কথা ছিল এক্সিম ব্যাংকের। জানা গেছে, টেলিটকের প্রকল্পে এক বছর আগে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় ঠিকাদার অনেক বেশি দর দেওয়ায় প্রাক্কলনের চেয়ে প্রকল্প খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছিল। তাই প্রকল্পটি বাদ দিতে হয়েছে। এ ছাড়া ৭৫ শতাংশ ভারত থেকে যন্ত্রপাতি কিনতে হবে, এমন শর্তও মানা যায়নি।

এ বিষয়ে টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যন্ত্রপাতির দাম তুলনামূলক বেশি দিয়েছিলেন ঠিকাদার, যা আমাদের প্রকল্পের প্রাক্কলনের চেয়ে অনেক বেশি। এ ছাড়া ভারত থেকে কেনাকাটার শর্তও মেলানো যায়নি। এসব কারণে প্রকল্পটি বাদ দিতে হয়েছে।’

একই কারণে স্থানীয় সরকার বিভাগের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের যন্ত্রপাতি কেনার প্রকল্পটিও বাদ দেওয়া হয়। এই প্রকল্পে এক্সিম ব্যাংকের আড়াই কোটি ডলার দেওয়ার কথা ছিল। যন্ত্রপাতির দাম বেশি হওয়ায় প্রকল্পটি গত ৩১ মে এলওসির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।

এর আগে ২০২২ সালের ১৭ মার্চ আরও দুটি প্রকল্প বাদ দেওয়া হয়। এর মধ্যে একটি হলো খুলনা-মোংলা রেলসংযোগের সিগন্যালিং ব্যবস্থা সংযোজনের জন্য ডব্লিউডি-৩ প্যাকেজ। এই প্রকল্পে ভারতীয় ঠিকাদার বেশি দর দেওয়ায় প্রকল্পটি প্রত্যাহার করা হয়। এ ছাড়া একই দিনে জামালপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্প এলওসির তালিকা থেকে বাদ দেয় বাংলাদেশ। এই প্রকল্পে সাড়ে তিন কোটি ডলার বিনিয়োগের কথা ছিল। ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে এক্সিম ব্যাংকের শর্ত অনুযায়ী, ৭৫ শতাংশ কেনাকাটা ভারত থেকে করতে হয়। তাতে ইট-বালু, সিমেন্ট—সবই ভারত থেকে আনতে হতো।

এ ছাড়া ২০২২ সালের ১৪ মার্চ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নদীর ওপর বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ প্রকল্প (সাড়ে ১৮ কোটি ডলার); ২০২১ সালের ১৯ জুলাই কাটিহার-পার্বতীপুর-বরাহনগর বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন উন্নয়ন প্রকল্প (সাড়ে ৩৯ কোটি ডলার); ২০২১ সালের ২২ জুন যশোর, কক্সবাজার, পাবনা ও নোয়াখালীতে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্প (১৮ কোটি ডলার) এবং দেশের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী নিবন্ধনে প্রয়োজনীয় সুবিধা বৃদ্ধি করার প্রকল্প (২৮ কোটি ডলার) বাদ দেওয়া হয়। সর্বশেষ যে চারটি প্রকল্প প্রত্যাহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, এর আগে এই আটটি প্রকল্প তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল।

ইআরডির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ভারতের ঋণের প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা থেকে শুরু করে ঠিকাদার নিয়োগের প্রতিটি ধাপেই এক্সিম ব্যাংকের সম্মতি নিতে হয়। ফলে ঠিকাদার নিয়োগেই এক-দুই বছর সময় চলে যায়। এ ছাড়া ঋণের টাকায় কেনাকাটার শর্তও বেশ কঠিন। সেই শর্ত মেনে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণসংক্রান্ত প্রকল্প ভারতীয় ঋণে বাস্তবায়ন করা দুরূহ।

তিন এলওসির ছাড় মাত্র ১৩৫ কোটি ডলার

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২০১০ সালে ১০০ কোটি ডলারের প্রথম এলওসি সই হয়। পরে ১৪ কোটি ডলার অনুদানে রূপান্তর করে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দেয় ভারত। এরপর ২০১৫ সালে ২০০ কোটি ডলারের দ্বিতীয় এলওসি চুক্তি হয়। আর ২০১৭ সালে ৪৫০ কোটি ডলারের তৃতীয় এলওসি স্বাক্ষরিত হয়। ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, গত জুন মাস পর্যন্ত সব মিলিয়ে ১৪৯ কোটি ডলার ছাড় করেছে ভারতের এক্সিম ব্যাংক।

তিনটি এলওসিতে সড়ক ও রেল যোগাযোগ, রাস্তাঘাট নির্মাণসহ অবকাঠামো খাতের এ পর্যন্ত ৪০টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ যে চারটি প্রকল্প প্রত্যাহার করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাদ গেলে এলওসির তালিকায় থাকবে ৩৬টি প্রকল্প। এর মধ্যে ১৪টি প্রকল্প শেষ হয়েছে। চলমান আছে ৮টি প্রকল্প। বাকি প্রকল্পগুলো পরামর্শক নিয়োগ, ঠিকাদার নিয়োগ, প্রকল্প প্রস্তাবনা প্রস্তুত করা—এমন পর্যায়ে আছে।

এ ছাড়া চুক্তির শর্ত শিথিল করার বিষয়েও এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চলছে। যেমন এখন শুধু ভারতীয় ঠিকাদারেরাই এলওসি সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের দরপত্রে অংশ নিতে পারেন। ফলে ভারতীয় ঠিকাদারের একতরফা দামেই কার্যাদেশ দিতে হয়। তবে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ অংশীদারত্বের বা জয়েন্ট ভেঞ্চার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও যাতে দরপত্রে অংশ নিতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। এ ছাড়া কোনো প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ (কিছু ক্ষেত্রে শর্ত সাপেক্ষে ৬৫ শতাংশ) পণ্য বা সেবা ভারত থেকে কিনতে হবে—এমন শর্ত আছে। এই শর্ত শিথিল করার দর-কষাকষি চলছে।