জোড়াতালি দিয়ে সমাধানের চেষ্টা অনিশ্চয়তা বাড়ায়

অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ
ফাইল ছবি

আগে থেকেই অনুমান করা গিয়েছিল যে অর্থনীতির সংকট সহজে দূর হবে না। মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ এবং ডলার বাজারের অস্থিরতা সমস্যার আশু সমাধানও দেখা যাচ্ছে না; বরং যেভাবে জোড়াতালি দিয়ে সমন্বয়হীনভাবে সমস্যাগুলো সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, তাতে অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা বাড়ার আশঙ্কাই বেশি। প্রয়োজন ছিল সার্বিক অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য একটি সমন্বিত কৌশল নির্ধারণের স্বচ্ছ প্রক্রিয়া, যাতে আস্থার পরিবেশ তৈরি হয়।

গত অর্থবছরে আমদানি ব্যয় দ্রুত কমিয়ে আনা গেলেও বৈদেশিক লেনদেনের সমস্যার সমাধান হয়নি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দ্রুত পতন ঠেকানো গেলেও এখনো নিম্নমুখী চাপ রয়ে গেছে। বলা চলে আমদানি-রপ্তানি একটা নিম্ন পর্যায়ের ভারসাম্যে আমরা আপাতত পৌঁছেছি, এটা আমাদের মতো আমদানিনির্ভর অর্থনীতিকে চাঙা করা বা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সহায়ক হবে না।

আরও পড়ুন

বর্তমানের বিশ্ব অর্থনীতির সমস্যা শুরু হওয়ার আগে থেকেই নীতি নির্ধারণে কিছু ভুল আমরা করে ফেলেছি। যেমন টাকা-ডলারের মূল্যমান ধরে রাখা, রাজস্ব আয় না বাড়িয়ে ভ্যাট আদায়ের জন্য জ্বালানি তেলের মতো একটি সর্বজনীন উৎপাদন উপকরণের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে অর্থনীতির শক্তির প্রতীক ও আপৎকালীন রক্ষাকবচ হিসেবে না দেখে একে বিনিয়োগে সম্পদ হিসেবে গণ্য করা।

ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতির সংকট হঠাৎ যখন এসে পড়ল, ভুল শুধরানোর সময় ছিল না। এটাও উল্লেখযোগ্য যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখার জন্য জ্বালানি তেলের বকেয়া পরিশোধসহ কিছু কিছু ক্ষেত্রে বৈদেশিক পাওনা পরিশোধে গড়িমসি করা হচ্ছে, এর চেয়ে বরং আলোচনা করে পাওনা পরিশোধের একটা সময়সূচি তৈরি করার বিষয়ে সমঝোতা করা যেত। এটাও সমন্বিত স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনার একটি বিষয়। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থাগুলো আমাদের ঋণমান কমিয়ে দিয়েছে, যার ফলে ভবিষ্যতে ঋণের শর্ত আরও কঠিন হবে।

অর্থনীতির সংকটকালে আস্থাহীনতা একটি বড় সমস্যা। এটা মূল্যস্ফীতি কমানো, বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি বা রেমিট্যান্স আকৃষ্ট করা—এ সবকিছুরই সহায়ক নয়। মূল্যস্ফীতি একবার বেড়ে গেলে অর্থনীতিতে একধরনের মূল্যস্ফীতির প্রত্যাশা তৈরি হয়। যার ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। বর্তমানে বাজেট ব্যবস্থাপনা ও মুদ্রানীতিও মূল্যস্ফীতি উসকিয়ে দিতে পারে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের স্থবিরতা সত্ত্বেও জিডিপির অনুপাতে মুদ্রা সরবরাহ কেন বাড়ছে, তার কারণ স্পষ্ট নয়। সামনে নির্বাচনের মৌসুমে টাকা লেনদেন বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতির ওপর আরও চাপ আসতে পারে। এর ওপর খাদ্যঘাটতি দেখা দিলে পরিস্থিতি সামলানো আরও কঠিন হয়ে পড়বে।

ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলাহীনতা অর্থনীতিতে বাড়তি সমস্যা তৈরি করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বড় বড় আর্থিক অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে কেন ঋণখেলাপিদের ক্রমাগত বেশি ছাড় দিচ্ছে এবং সমস্যা-দুর্নীতি জর্জরিত ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে ঋণসুবিধার সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে, তা–ও বোধগম্য নয়। এতে কেবল সমস্যার সাময়িক সমাধানই হবে, কিন্তু আর্থিক খাতের পুঞ্জীভূত দায়দেনার বোঝা শেষ পর্যন্ত পুরো অর্থনীতিকেই বইতে হবে।

বিদেশে যে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা প্রতিবছর পাচার হচ্ছে, এটা সবাই স্বীকার করেন। তবে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বর্তমান সংকটকালে এটা অনেক বড় সমস্যা। আবার রেমিট্যান্সের একটা বড় অংশও সম্পদ পাচারে ব্যবহৃত হচ্ছে। পরিস্থিতি দৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো একে অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে দিয়ে দায়িত্ব সারছে।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলারের মতো অর্থ দিয়ে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) তৈরি করা হয়েছিল, তার থেকে বেসরকারি খাতের নেওয়া ঋণের কিছু কিছু অংশ খেলাপি হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। এসব খেলাপি ঋণের বোঝা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংককেই বহন করতে হবে।

বৈদেশিক ঋণের বোঝা এখনো জিডিপির ৩০ শতাংশের মধ্যে আছে বলে নীতিনির্ধারকেরা হয়তো স্বস্তিবোধ করতে পারেন। কিন্তু গত কয়েক বছরে এ ঋণের বোঝা যে হারে বাড়ছে, তা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতের জন্য শঙ্কার কারণ আছে, নতুন ঋণের কথা না হয় বাদই দিলাম। গত তিন বছরেই বৈদেশিক ঋণের বোঝা ৫০ শতাংশ বেড়ে ১০০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছেছে। বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পের পেছনেই এই ঋণ খরচ হচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু এসব প্রকল্পের অগ্রাধিকার, ব্যয়ের সাশ্রয় ও বাস্তবায়ন দক্ষতার বিষয়ে প্রশ্ন আছে।

দেশ দেউলিয়া হয়ে যাওয়া বা না যাওয়াই একমাত্র বিষয় না। ভৌত অবকাঠামোর ব্যয়ের পেছনে বড় অর্থনৈতিক যুক্তি হলো, এর ফলে বিশেষত রপ্তানিমুখী দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হয় কি না, যাতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ে এবং ঋণ পরিশোধে অসুবিধা না হয়। বর্তমান বছরগুলোতে মাত্র নিট এক বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি যে বৈদেশিক বিনিয়োগ বা এফডিআিই আসছে, তা কোনোভাবেই আশাব্যঞ্জক নয়।

অথচ এখন পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণের যে দায় তৈরি হয়েছে, তার ফলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই বছরে ৪ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। সুতরাং ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক সামর্থ্যের বিপরীতে ঋণ পরিশোধের এসব হিসাব–নিকাশ বিবেচনায় নিয়েই কেবল আমাদের ঋণনির্ভর নতুন অবকাঠামো প্রকল্পে হাত দেওয়া উচিত হবে।

  • ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, অর্থনীতিবিদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা