আমানতের চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি

আমানতের চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি। এক-তৃতীয়াংশের বেশি আমানত আসে ৩ থেকে ৬ মাস মেয়াদি এফডিআর থেকে।

৫ বছরে ব্যাংক খাতের আমানত ও ঋণচিত্র
প্রথম আলো

ব্যাংকিং ব্যবস্থার অধীন সরকারি ও বেসরকারি খাতে যাওয়া ঋণের পরিমাণ বেড়ে ২০ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। পাঁচ বছর আগের তুলনায় ঋণ বেড়েছে সাত লাখ কোটি টাকা। তবে শুধু ঋণ নয়, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আমানতও। ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল সাড়ে ১৭ লাখ কোটি টাকা। পাঁচ বছর আগের তুলনায় ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে পাঁচ লাখ কোটি টাকা। সেই হিসাবে, দেশে আমানতের চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৪ বিশ্লেষণ করে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে। সমীক্ষা প্রতিবেদনটি ৬ জুন জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। এতে আমানতের তথ্য ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এবং ঋণের তথ্য ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে।

অর্থনৈতিক সমীক্ষা প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বলেছেন, আমানতের হালানাগাদ অর্থাৎ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তথ্য পাওয়া গেলে এই চিত্র কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। আগামী ডিসেম্বর মাসে নতুন সমীক্ষা প্রকাশিত হরে পুরো চিত্র পাওয়া যাবে।

সাধারণভাবে আমানতের চেয়ে ঋণ বেশি হতে পারে না। তবে ব্যাংকের আমানতের বাইরেও সরকার অনেক সময় টাকা ছাপিয়ে ঋণ নেয়। এ অঙ্ক আমানতের বাইরে থাকে। সে ক্ষেত্রে ঋণের পরিমাণ বেশি হতে পারে।

ঋণ বেশি হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানা যায়, বিনিয়োগের হিসাবকে ঋণে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিনিয়োগ মূলত এক ব্যাংক আরেক ব্যাংকে যে টাকা ধার দেয় সেটা, আবার এই টাকা সরকারি খাতে ধার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ফলে বিনিয়োগের টাকা প্রকৃত ঋণ নয়।  

ঋণের পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণ হচ্ছে ঋণ যা দেওয়া হয়, তা অনেক সময় ফেরত আসে না। অথচ ব্যাংকগুলোকে হিসাবটা ঠিকই দেখাতে হয়। এতে ঋণের স্থিতির অঙ্কটা বড় হয়ে যায়।
সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

সমীক্ষায় পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, প্রতিবছর এক লাখ কোটি টাকা আমানত বাড়ছে। কিন্তু ঋণ বাড়ছে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা করে। এদিকে ব্যাংক খাতে মোট আমানতের এক-তৃতীয়াংশের বেশি এসেছে স্থায়ী হিসাবে (এফডিআর)। আর ঋণের এক-চতুর্থাংশ গেছে সরকারের কাছে।

অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতের আমানত ছিল ১৭ লাখ ৪৯ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। আর এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ২০ লাখ ৪ হাজার ১০৯ কোটি টাকা। পাঁচ বছর আগে আমানতের পরিমাণ ছিল ১২ লাখ ৬৪ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। আর ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ৭ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা।

সমীক্ষায় সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের ঋণের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকারের কাছে ব্যাংক খাতের ঋণ ছিল ৪ লাখ ২৭ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। অথচ পাঁচ বছর আগেও এ ঋণ ছিল ২ লাখ ১০ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ব্যাংকে ঋণ দাঁড়ায় ১৫ লাখ ৭৬ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা, যা ৫ বছর আগে ছিল ১০ লাখ ৯৭ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা।

দেশের ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম রেজা ফরহাদ হোসেন এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বাস্তবে আমানত ও ঋণ—দুটোরই প্রবৃদ্ধির গতি কমেছে। ঋণের প্রবৃদ্ধি একটু বেশি দেখা যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে কেউ চক্রবৃদ্ধি সুদের কবলে পড়েছেন, কেউ আবার শিকার হয়েছেন মার্কিন ডলারের তুলনায় টাকার অবমূল্যায়নের। ফলে ঋণের টাকা পরিশোধ করছেন না অনেকে এবং ব্যাংক খাতে ভালো ঋণের বদলে খারাপ ঋণ বাড়ছে।

ঋণের প্রবৃদ্ধি একটু বেশি দেখা যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে কেউ চক্রবৃদ্ধি সুদের কবলে পড়েছেন, কেউ আবার শিকার হয়েছেন মার্কিন ডলারের তুলনায় টাকার অবমূল্যায়নের।
সেলিম রেজা ফরহাদ হোসেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ব্র্যাক ব্যাংক

এক-তৃতীয়াংশ আমানত এফডিআরে

অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, আমানত রাখার জন্য একসময় ১৬ ধরনের হিসাব ছিল ব্যাংকগুলোতে। বর্তমানে আছে ১৪ ধরনের হিসাব। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস বিবেচনায় নিয়ে দেখা যায়, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমানত এসেছে এফডিআর থেকে। এফডিআরের আছে আবার পাঁচটি শ্রেণি। এগুলো হচ্ছে তিন থেকে ছয় মাস, ছয় মাস থেকে এক বছর, এক থেকে দুই বছর, দুই থেকে তিন বছর ও তিন বছরের বেশি সময়ের জন্য আমানত। এগুলোতে গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত জমা হয়েছে ৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। ৫ বছর আগে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এ ধরনের আমানত ছিল ৫ লাখ ৬৫ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা।

পাঁচ শ্রেণির এফডিআরের মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৮২ কোটি টাকা আমানত এসেছে তিন থেকে ছয় মাস সময়ের জন্য। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আমানত এসেছে এক থেকে দুই বছরের মেয়াদে, পরিমাণ ২ লাখ ৩৪ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা। তৃতীয় সর্বোচ্চ আমানত ছয় মাস থেকে এক বছর সময়ের জন্য, পরিমাণ ১ লাখ ১৫ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা।

এ ছাড়া তিন বছরের বেশি সময়ের এফডিআরে আমানত ছিল ৭৮ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা এবং সবচেয়ে কম ১৩ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা আমানত ছিল দুই থেকে তিন বছর মেয়াদি এফডিআরে।

ব্যাংক আমানতের উল্লেখযোগ্য বাকি দুটি ধরন হচ্ছে সঞ্চয়ী হিসাব ও চলতি হিসাব। ব্যাংকগুলো এ সময়ে সঞ্চয়ী আমানত পেয়েছে ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৯১৯ কোটি টাকা, আর চলতি আমানত পেয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা। অনেক ব্যাংকেরই পেনশন কর্মসূচি রয়েছে। পেনশন আমানত বাবদ ব্যাংকগুলো পেয়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা।

আমানতের চেয়ে ঋণের পরিমাণ বেশি কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ঋণের পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণ হচ্ছে ঋণ যা দেওয়া হয়, তা অনেক সময় ফেরত আসে না। অথচ ব্যাংকগুলোকে হিসাবটা ঠিকই দেখাতে হয়। এতে ঋণের স্থিতির অঙ্কটা বড় হয়ে যায়।

সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, এখন যেটা আছে, সেটা তা–ও চলে। তবে আমানত ও ঋণের ফারাকটা যদি অনেক বেশি হয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে যে ব্যাংক খাতের সম্পদ ও দায় ব্যবস্থাপনার মধ্যে একধরনের অব্যবস্থাপনা চলছে। অব্যবস্থাপনা দূর করতে ব্যাংক খাতকে সক্রিয় হতে হবে।