মূল্যস্ফীতির চাপ ঠেকাতে নতুন বেতন কমিশন
এক দশক পর সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নতুন বেতনকাঠামো নির্ধারণ করতে বেতন কমিশন গঠন করা হয়েছে। এ কমিশনের প্রধান করা হয়েছে সাবেক অর্থসচিব ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান জাকির আহমেদ খানকে। কমিশনকে ছয় মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এ কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ।
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর বিকেলে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ১০ বছর পর বেতন কমিশন হলো। গত সরকারের সময়ে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্ক ছাড়িয়ে গিয়েছিল। যদিও এটিকে গত মাসে ৮ শতাংশে নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির সঙ্গে বেতনের সমন্বয় এখনো ঠিকমতো হয়নি। সে জন্যই সরকার মনে করছে, একটি বেতন স্কেল হওয়া উচিত।
রাজস্ব আদায় বাড়াতে না পারলে নতুন বেতন কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করা কঠিন হবে।মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
বেতন কমিশন গঠন করায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের সভাপতি মো. বাদিউল কবীর ও মহাসচিব নিজাম উদ্দিন আহমেদ।
তবে রাজস্ব আদায়ে নিম্নগতি, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কম, পাল্টা শুল্কের কারণে রপ্তানি–বাণিজ্যে ঝুঁকি, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে দুরবস্থা—অর্থনীতিতে এত সমস্যা থাকার পরও নতুন বেতন কমিশন গঠন অগ্রাধিকারে রাখা কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ। তাঁদের মতে, এর ফলে বাজেটে পরিচালন খরচ বাড়ানোর ক্ষেত্র তৈরি করা হচ্ছে, যা বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে আসার পর থেকে সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা নিয়ে আলোচনা শুরু হয় ২০২৪ সালের নভেম্বরে। চলতি ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার জন্য একটি কমিটি কাজ শুরু করে। এ নিয়ে বিরূপ সমালোচনা শুরু হলে সরকার পিছিয়ে যায়। পরে চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের বিশেষ সুবিধা চালু হয়। এতে বেতন আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভায় বেতন কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
সর্বশেষ বেতন কমিশনে যা ছিল
২০১৩ সালে সর্বশেষ বেতন কমিশন গঠন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন এ কমিশনের প্রধান ছিলেন। ওই কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ২০১৫ সাল থেকে নতুন বেতনকাঠামো কার্যকর হয়। তখন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়। ওই কমিশন প্রতিবছর দুইভাবে বেতন-ভাতা বৃদ্ধির সুপারিশ করেছিল। এক. মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে বেতন–ভাতা বৃদ্ধি। দুই. প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে বেতন-ভাতা বাড়ানো। নতুন করে আর বেতন কমিশন গঠনের প্রয়োজন হবে না বলে তখন বলা হয়েছিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তখন দেখিয়েছিলাম, এই বেতন স্কেল বাস্তবায়ন করা হলে কোনো বাজেটঘাটতি হবে না। তবে আগের সরকার প্রতিবছর বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দুটি পন্থার কোনোটিই পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। বর্তমানে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান আছে। এতে খরচ অনেক বেড়ে গেছে। তাই প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে পারছেন না অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী। এসব বিবেচনায় এখন একটি বেতন কমিশন গঠনের যৌক্তিকতা আছে।’
মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন আরও বলেন, তবে এ মুহূর্তে অর্থনীতির ক্ষেত্রে সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত রাজস্ব আদায় বাড়ানো। যাদের রাজস্ব দেওয়ার কথা, তাদের কাছ থেকে কোনো সরকারই রাজস্ব আদায় করতে পারেনি। রাজস্ব আদায় বাড়াতে না পারলে নতুন বেতন কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করা কঠিন হবে। অন্যদিকে ৬৮ শতাংশ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নও কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
২০১৩ সালে সর্বশেষ বেতন কমিশন গঠন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন এ কমিশনের প্রধান ছিলেন। ওই কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ২০১৫ সাল থেকে নতুন বেতনকাঠামো কার্যকর হয়।
আর্থিক সংগতি কতটা
নতুন বেতন কমিশন আগামী ছয় মাসের মধ্যে বেতন-ভাতা বাড়ানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশ করবে। সুপারিশ অনুসারে বেতন-ভাতা বাড়ানো হলে সরকারের নতুন করে কয়েক হাজার কোটি টাকা বাড়তি দরকার হতে পারে। এটি সরকারের পরিচালন খরচের বরাদ্দ থেকে দিতে হবে।
তবে সরকারের রাজস্ব আদায়ের চিত্র ভালো নয়। বিদায়ী অর্থবছরে (২০২৪-২৫) রাজস্ব আদায়ে প্রায় ৯৩ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি ছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)। যা এযাবৎকালের রেকর্ড ঘাটতি। বিদায়ী অর্থবছরে সব মিলিয়ে এনবিআরের শুল্ক, ভ্যাট ও কর বিভাগ আদায় করেছে ৩ লাখ ৭০ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা। এনবিআরের সংশোধিত লক্ষ্য ছিল ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এনবিআর বাজেটের স্থানীয় উৎসের অর্থের ৮০ শতাংশের বেশি জোগান দেয়। কিন্তু রাজস্ব খাতে সংস্কার না হওয়ায় অভ্যন্তরীণ খাত থেকে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় করা যাচ্ছে না। এর মধ্যে নতুন বেতন কমিশনের মাধ্যমে খরচ আরও বাড়বে।
নতুন বেতন কমিশন আগামী ছয় মাসের মধ্যে বেতন-ভাতা বাড়ানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশ করবে। সুপারিশ অনুসারে বেতন-ভাতা বাড়ানো হলে সরকারের নতুন করে কয়েক হাজার কোটি টাকা বাড়তি দরকার হতে পারে। এটি সরকারের পরিচালন খরচের বরাদ্দ থেকে দিতে হবে।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনীতিতে বিনিয়োগ স্থবিরতা, কর্মসংস্থানে ভাটা, রাজস্ব আদায় শ্লথগতি, এডিপির দুরবস্থা—এত সমস্যা থাকা সত্ত্বেও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি কি অগ্রাধিকার হতে পারে? ২০১৫ সালে বাস্তবায়ন করা বেতন স্কেল অনুসারে তাঁরা বেশ আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা পান, যা বেসরকারি খাতের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক।
জাহিদ হোসেন বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে বেতন কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করি না। এখন বাজেটে প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে পারছে না। অথচ নতুন করে খরচের ক্ষেত্র তৈরি করা হচ্ছে।’