ওএমএসের ট্রাক
২৫ কেজি চাল পেতে ৫০ জোড়া হাত
বাজারে সব পণ্যের দাম বেশি। চালের দাম চূড়ায় উঠে আর নিচে নামছে না। এ জন্য মানুষ চাল পেতে দীর্ঘ সারিতে অপেক্ষা করছে।
২৫ কেজি চালের শেষ বস্তাটি যখন ট্রাকের ওপর খোলা হয়, তখনো সামনে অর্ধশতাধিক লোকের জটলা। সবাই হাত বাড়িয়ে আছেন। চাল নিয়ে বাড়িতে ফিরতে চান। কিন্তু এই চাল তো পাঁচজনের বেশি পাবেন না। বাকিদের শূন্য হাতে ফিরতে হবে। অথচ তাঁদের মধ্যে অনেকেই ভোর থেকে এই পাঁচ কেজি চালের অপেক্ষা করছিলেন।
গতকাল সোমবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউন হল এলাকায় সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি ওএমএসের (খোলাবাজারে বিক্রি) ট্রাকের সামনে এমন দৃশ্যই দেখা গেছে। বিকেল চারটা পর্যন্ত চাল ও আটা বিক্রির কথা থাকলেও বেলা দুইটার মধ্যেই সব পণ্য শেষ। গুনে গুনে দেখা গেল, সেখানে তখনো ৫৩ জন মানুষ পণ্য না পেয়ে শোরগোল শুরু করছেন।
সকালের দিকে যারা আসে, তারা চাল ও আটা দুইটাই পায়। কাজের জন্য আসতে দেরি হওয়ায় আমাদের কপালে কিছুই জুটল না। অথচ আমার চালের খুব দরকার ছিল।
তাঁদেরই একজন স্থানীয় বাসিন্দা সালমা আক্তার। ওএমএসের চাল না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, ‘সেই সকাল থেকে লাইনে আছি। এরপরেও চাল পেলাম না। নয়টার ট্রাক আসল এগারোটায়। তা–ও যদি চাল নিয়ে বাসায় ফিরতে পারতাম, তাহলে হতো। এই সময়ে কাজ করলেও লাভ ছিল। চাল না দিতে পারলে ট্রাকে বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হোক। কিন্তু কেউ পাবে, আর কেউ পাবে না, তা হতে পারে না। কারণ, সবাই এখন কষ্টে আছে।’
মেট্রো হাউজিং এলাকার মোহাম্মদ সিদ্দিকের অভিযোগও কাছাকাছি। তিনি বলেন, ‘সকালের দিকে যারা আসে, তারা চাল ও আটা দুইটাই পায়। কাজের জন্য আসতে দেরি হওয়ায় আমাদের কপালে কিছুই জুটল না। অথচ আমার চালের খুব দরকার ছিল।’ অনেকে পাঁচ কেজির বেশি চাল পেয়েছেন, সঙ্গে আটাও নিয়েছেন বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
এই অবস্থা যে শুধু মোহাম্মদপুরের তা নয়; রাজধানীর অন্য এলাকাতেও ওএসএমের ট্রাকের সামনে প্রায় একই চিত্র লক্ষ করা গেছে। যেমন মিরপুর ৬ নম্বরের চলন্তিকা বস্তি এলাকায় সকাল সাড়ে সাতটা থেকে ওএমএসের লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন সত্তরোর্ধ্ব অজিফা বেগম। তাঁর ছেলে ভ্যান চালান আর পুত্রবধূ একটি পোশাক কারখানায় আট হাজার টাকা বেতনে কাজ করেন। তাঁদের আয়ে সংসার খরচ চলে না দেখে দুর্বল শরীর নিয়ে অজিফা বেগম নিজেই কম দামের ওএমএসের পণ্য কিনতে আসেন। এই বৃদ্ধা বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহে একবার আসি। তবে ভিড় বেশি থাকলে কখনো কখনো না কিনেই ফিরতে হয়।’
চলন্তিকা বস্তি এলাকায় ওএমএসের লাইনে তিনজন অন্তঃসত্ত্বা নারী এবং দুই মাসের কম বয়সী শিশুসহ আরও দুই নারীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এ ছাড়া ছিলেন দিনমজুর, সিটি করপোরেশনের কর্মী, রিকশাচালক, গৃহকর্মীসহ বিভিন্ন পেশার নিম্ন আয়ের নারী-পুরুষেরা। নিম্ন আয়ের এসব মানুষ এখন কোথায় একটু সস্তায় খাবার পাওয়া যায়, তা–ই খুঁজছেন।
মাত্র ১ মাস ২৪ দিন বয়সী পুত্র আফিফ হোসেনকে কোলে নিয়ে মিরপুরের ওই ওএমএসের ট্রাকের লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা মৌসুমি আক্তার। তিনি জানান, ‘এর আগে কখনো ওএমএসের ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে আসিনি। কিন্তু বাজারে জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে সংসার খরচ আর সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে একটু কম দামে পণ্য কিনতে আজই প্রথম ওএমএসের ট্রাক থেকে পণ্য কিনেছি।’
ওএমএসের ট্রাক থেকে পণ্য কেনার জন্য সারিতে আজকাল নতুন নতুন মানুষ যেমন দেখা যাচ্ছে, তেমনি চলনে-বলনে অনেকটা মধ্যবিত্ত, কেতাদুরস্ত ধাঁচের মানুষও এসে দাঁড়াচ্ছেন। তাঁদের অনেকে অবশ্য সরাসরি লাইনে না দাঁড়িয়ে ট্রাকের পাশে এসে বিক্রেতাদের বলে-কয়ে চাল পাওয়া যায় কি না, সেই চেষ্টা করে থাকেন।
তেমনই একজন মোহাম্মদপুর টাউন হল এলাকার আবদুল হালিম। কেতাদুরস্ত পোশাকে এসে ট্রাকের পাশে অনেকক্ষণ চুপচাপ ছিলেন। পরে চাল শেষ হয়ে যাচ্ছে দেখে তিনি বলে ওঠেন, ‘সবাই তো পাবে না। না হয় আমি পাঁচ কেজি নিতাম। সবাই তো লাইনে এসে দাঁড়াতে পারে। অনেকেই আছেন, যাঁদের কখনো লাইনে দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু তাঁরাও কষ্টে আছেন।’
সরেজমিনে মোহাম্মদপুর ও মিরপুরের ওএমএসের ট্রাকের চাল-আটা বিক্রির স্থানে দেখা যায়, মানুষ ভোর থেকে ভিড় জমাচ্ছেন। পণ্য পেতে হুড়োহুড়ি করছেন। সারিতে দাঁড়ানো নিয়ে ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি এবং মারামারিও হচ্ছে। এর মধ্যে অনেকে পণ্য না পেয়ে বাসায় ফিরে যান। আবার অনেকে পণ্য একাধিকবারও কিনছেন। অভিযোগ আছে, ডিলাররা কিছু চাল না বিক্রি করে ট্রাকে করে নিয়ে চলে যান।
বাজারে জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে সংসার খরচ আর সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে একটু কম দামে পণ্য কিনতে আজই প্রথম ওএমএসের ট্রাক থেকে পণ্য কিনেছি।
খোলাবাজারে বিক্রি (ওএমএস) কর্মসূচির আওতায় সরকারি সংস্থা খাদ্য অধিদপ্তর এ চাল বিক্রি করে। প্রতি কেজির দাম ৩০ টাকা। সঙ্গে থাকে আটা—প্রতি কেজি ১৮ টাকা। একেকজন ক্রেতা পাঁচ কেজি চাল পেলে মোট দাম পড়ে ১৫০ টাকা। বাজারে একই পরিমাণ চালের দাম ২৭৫ টাকার মতো।
খাদ্য অধিদপ্তর প্রতিবছরই চাল ও আটা বিক্রি করে। তবে রাজধানীতে এবারও আটা কম করে দেওয়া হচ্ছে। বাজারে প্রতি কেজি আটা অনেক ক্ষেত্রে ৭০ টাকার বেশি পড়ছে।
করোনাকালের আগে খাদ্য অধিদপ্তরের ট্রাকের পেছনে কোনো ভিড় দেখা যেত না। এমনকি ২০২০ ও ২১ সালেও মানুষের এতটা ভিড় দেখা যায়নি। কেন মাত্র পাঁচ কেজি চাল ও চার কেজি আটা কিনতে ভোরবেলায় এসে মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন—তার কারণ জানালেন কয়েকজন। এমনই একজন মিরপুরের ঝিলপাড় বস্তি এলাকার বাসিন্দা নুরু মিয়া। তিনি বলেন, ‘মানুষ এখন কামে কম নেয়। সাহায্যের জন্য অন্যের কাছে কইতেও তো লজ্জা লাগে। এ জন্য নিরুপায় হয়ে এখানে লাইনে দাঁড়াই। অপেক্ষা করে দেখি চাল পাই কি না। সব দিন তো আর পাই না। মাঝেমধ্যে পাই। তাতেও বেশ সাশ্রয় হয়।’
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ঢাকা রেশনিং দপ্তরের কর্মকর্তা আমিরুল ইসলাম বলেন, চার-পাঁচ মাস আগেও সারা দিনে ট্রাকের সব পণ্য বিক্রি হতো না। প্রায় অর্ধেক মাল নিয়ে ফিরে যেতে হতো। এখন দুপুর শেষ হওয়ার আগেই ওএমএসের পণ্য বিক্রি শেষ হয়ে যাচ্ছে। মানুষের চাহিদা অনুসারে পণ্য দেওয়া যাচ্ছে না।
একই কথা জানালেন মোহাম্মদপুর টাউন হল এলাকার ওএমএস ট্রাকের ডিলার প্রতিনিধি শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আগে মানুষের চাহিদা কম ছিল। তখন দেওয়া হতো সাড়ে তিন টন চাল। এখন মানুষের চাহিদা বেড়েছে, কিন্তু চাল ও আটা মিলিয়ে দেওয়া হয় তিন টন পণ্য। এর মধ্যে অনেকে পণ্য নিয়ে ঘুরেফিরে এসে আবার লাইনে দাঁড়ান। তদারকির কোনো পদ্ধতি নেই।’