ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ১,২০০ কোটি টাকা নিল, কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানে না: এ কে আজাদ

ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের যথেষ্ট ক্ষমতা নেই বলে মনে করেন সংসদ সদস্য ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ। তিনি বলেন, একটি ব্যাংক থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা নিয়ে গেল একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। বাংলাদেশ ব্যাংক তা জানে না। ব্যাংকের একক গ্রাহক ঋণসীমা আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক পরে তদন্ত করে এ ঘটনা বের করেছে। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতায়ন ঘাটতির কারণে এসব হচ্ছে।

আগামী অর্থবছরের বাজেট নিয়ে এক আলোচনায় এ কে আজাদ প্রশ্ন তোলেন, যাঁরা ঋণের নামে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে বাইরে চলে গেলেন এবং বিনিয়োগ করলেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে? তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোতে অনেক খেলাপি ঋণকে বিভিন্নভাবে নিয়মিত দেখানোর প্রবণতা রয়েছে। ব্যাংক খাতে এখন ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ দেখানো হচ্ছে। তবে অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলামের মতে, খেলাপি ঋণ হবে প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা।

আজ রোববার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অনুষ্ঠিত ‘প্রাক্‌-বাজেট আলোচনা: বেসরকারি খাতের প্রত্যাশা’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এ কে আজাদ এসব কথা বলেন। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই), সমকাল এবং চ্যানেল টোয়েন্টিফোর যৌথভাবে এ সভার আয়োজন করে।

অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এতে প্রধান অতিথি ছিলেন। দুই বিশেষ অতিথির আরেকজন ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মো. আবুল কালাম আজাদ। আর সম্মানিত অতিথি ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হাবিবুর রহমান। ডিসিসিআই সভাপতি আশরাফ আহমেদের সঞ্চালনায় আগামী বাজেট সামনে রেখে চারটি বিষয়ের ওপর আলোচনা হয়। এগুলো হলো আয়কর ও মূসক, আর্থিক খাত, শিল্প ও বাণিজ্য এবং অবকাঠামো উন্নয়ন।

আলোচনায় অংশ নিয়ে ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদ নিয়েও কথা বলেন সংসদ সদস্য ও হা-মীম গ্রুপের কর্ণধার এ কে আজাদ। তিনি বলেন, ৯ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে এখন ১৪ শতাংশ গুনতে হচ্ছে। বাড়তি সুদের কারণে অনেকে খেলাপি হয়ে পড়বেন বলে তাঁর আশঙ্কা। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ৫ শতাংশ অতিরিক্ত সুদের দায়িত্ব এখন কে নেবে? এর জন্য ব্যবসায়ীদের তো কোনো প্রস্তুতি ছিল না।

দেশে ডলার–সংকট কাটেনি বলে জানান শীর্ষস্থানীয় এই ব্যবসায়ী। এ কে আজাদ বলেন, ডলারের সরকারি দর ১১০ টাকা। অথচ আমদানিতে কিনতে হচ্ছে ১২৪ টাকা দরে। এদিকে শুল্ক কর্তৃপক্ষ শুল্কায়ন করছে ১২৪ টাকা ধরে। সরকারি অন্যান্য সংস্থা ডলারের দর ১১০ টাকা ধরে হিসাব করছে। তাদের মতে, ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে ডলারের দর বাড়ান। সব দোষ ব্যবসায়ীদের না দিয়ে এ অবস্থার অবসান চান তিনি।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ্যক্রমের সমালোচনা করে এ কে আজাদ বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শত বছর ধরে পালি ও কাছাকাছি কিছু বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স এবং পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে। এসব বিষয় যেখানে পড়ানো হয়, জনগণের করের টাকায় সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তুকি দেওয়া হয়। এসব অর্থ অপচয়ের মানে হয় না। আমাদের এখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) দরকার। সেগুলো না করে কেন বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করা হচ্ছে? এগুলোর সঙ্গে বাস্তবতার মিল কোথায়, তা ভেবে দেখা দরকার।’

দেশে বেকারের সংখ্যা দুই কোটি উল্লেখ করে সংসদ সদস্য এ কে আজাদ বলেন, ‘দক্ষ জনবল পাচ্ছে না দেশ। ১ লাখ ২৫ হাজার বিদেশি আমাদের দেশে চাকরি করছেন। তাঁরা বিপুল পরিমাণ অর্থ এ দেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছেন।’ বর্তমানে যেভাবে রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে, এনবিআরের একার পক্ষে তা সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি। তাঁর মতে, এ জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার দরকার।

অন্যরা যা বললেন

অর্থ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীরা অনেক ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। অন্যদিকে, বিদেশিরা ঝুঁকি নিতে চান না। তাঁরা করের ক্ষেত্রে নীতির ধারাবাহিকতা চান। বিনিয়োগ বাড়াতে দরকার বন্ড ও বিমা খাতের উন্নয়ন।

করব্যবস্থাকে আরও সহজীকরণ করা দরকার বলেও মনে করেন আবুল কালাম আজাদ। বলেন, স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা হচ্ছে। তবে আরও সহজীকরণ দরকার। ব্যাংক খাতে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি যাতে তৈরি না হয়, সেদিকেও বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।

এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, করের আওতা বাড়ানোর বিষয়টি যত সহজে বলা হয়, বিষয়টি তত সহজ নয়। তবে কর আহরণ এনবিআরের একমাত্র লক্ষ্য নয়। এরই মধ্যে বিভিন্ন খাতে করহার কমানো হয়েছে। ব্যক্তি করদাতার সংখ্যা ২০২০ সালের ২১ লাখ থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩৭ লাখে উন্নীত করা হয়েছে। বিআইএনধারী ভ্যাটদাতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২০২০ সালের ২ লাখ থেকে এখন ৫ লাখে উন্নীত করা হয়েছে।

আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশে উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে করনীতি নেওয়া হয়েছে বলেও জানান এনবিআর চেয়ারম্যান। বলেন, উচ্চ মূল্য সংযোজিত রপ্তানি পণ্য উৎপাদনে বিভিন্ন ধরনের ছাড় দেওয়া হচ্ছে। সরকারের নীতির কারণেই মোবাইল ফোন, টেলিভিশন, ফ্রিজ ও এসির উৎপাদন বেড়েছে। এসব পণ্যের ৯৫ শতাংশ এখন দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ বলেন, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধন করা হয়েছে। এ ছাড়া অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিছু ব্যাংক একীভূত করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হবে। ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় পথনকশা অনুযায়ী কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে সুদহার বাড়ানো হয়নি। এটা নিয়ে অভিযোগ করা ঠিক নয়। আমরা ধীরে ধীরে বাড়িয়েছি। বাইরের অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত অনেক কিছু আমাদের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তার মধ্যে মূল্যস্ফীতি ও খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে এ প্রভাব বেশি পড়েছে।’

ডেপুটি গভর্নর মো. হাবিবুর রহমান আরও বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সুদহার বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বের অন্যান্য দেশ অনেক আগে থেকেই আগ্রাসীভাবে সুদহার বাড়ানোর নীতি নিয়েছে। আমরা এ ক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা চিন্তা করে অনেক দেরিতে সুদহার বাড়িয়েছি।’

সুদের ‘স্মার্ট রেট’ নিয়ে অনেকে সমালোচনা করেন উল্লেখ করে হাবিবুর রহমান বলেন, কেউ কেউ বলেন আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে এটা করা হয়েছে। সেটা ঠিক নয়। স্মার্ট কার্যকর না করে কেবল বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে সুদহার একবারে অনেক বেড়ে যেত।

তবে অর্থমন্ত্রীর সামনে অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হলেও তিনি কোনোটির বিষয়েই মন্তব্য করেননি।

আইসিসি বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমানসহ ব্যবসায়ী নেতারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। আর বক্তব্য দেন ঢাকা চেম্বারের সাবেক চার সভাপতি আফতাবুল ইসলাম, রিজওয়ান রহমান, সামীর সাত্তার ও শামস মাহমুদ; বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এম মাশরুর রিয়াজ, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাবেক কমিশনার আরিফ খান, এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন, ইউনিলিভার বাংলাদেশের কর বিভাগের প্রধান সাঈদ আহমেদ খান, সোনালী আঁশ ইন্ডাস্ট্রিজের এমডি মাহবুবুর রহমান পাটওয়ারি, ইফাদ গ্রুপের পরিচালক তাসকিন আহমেদ, কনফিডেন্স গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ইমরান করিম, সামিট অ্যালায়েন্স পোর্টের এমডি সৈয়দ আলী জওহর রিজভী প্রমুখ।