সংশোধিত এডিপিতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বড় ‘কোপ’

  • শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সবচেয়ে কম খরচ করে বাংলাদেশ।

  • শিক্ষা খাতে জিডিপির ২ শতাংশের মতো অর্থ খরচ করা হচ্ছে। আর স্বাস্থ্য খাতে তা ১ শতাংশেরও কম।

প্রতীকী ছবি: প্রথম আলো

উন্নয়ন খরচে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত অগ্রাধিকারের তালিকায় বরাবরের মতো বেশ পিছিয়ে আছে। উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দের দিক থেকে শীর্ষ তিনটি খাতের মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত নেই। অথচ দীর্ঘদিন ধরে এ দুই খাতের বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলে আসছেন খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তারপরও বরাদ্দ বাড়ছে না। উল্টো সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) এ দুই খাতে বরাদ্দ কমানো হচ্ছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সূত্রে জানা গেছে, এবার সংশোধিত এডিপির আকার কমছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। তাতে এডিপির আকার কমে ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকায় নামছে।

আগামী সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় সংশোধিত এডিপি অনুমোদন দেওয়া হতে পারে।

আইএমইডি সূত্রে জানা গেছে, সংশোধিত এডিপির মাত্র ৭ শতাংশের মতো বরাদ্দ রাখা হচ্ছে শিক্ষা খাতে। এই খাতের ১১৮টি প্রকল্পে সব মিলিয়ে ১৭ হাজার ২২৩ কোট টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। মূল এডিপির চেয়ে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ কমছে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। অন্যদিকে স্বাস্থ্য খাতের ৬১টি প্রকল্পে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ১২ হাজার ৬৬ কোটি টাকা, যা সংশোধিত এডিপির প্রায় ৫ শতাংশ। এ খাতে বরাদ্দ কমছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি কম থাকায় এ দুই খাতে সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ কমানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম বিভাগের কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এডিপি সংশোধনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ‘কোপ’ পড়েছে এ দুই খাতে।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে এশীয়–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সবচেয়ে কম অর্থ খরচ করে বাংলাদেশ। এখন শিক্ষা খাতে জিডিপির ২ শতাংশের মতো খরচ করা হচ্ছে। আর স্বাস্থ্য খাতে তা ১ শতাংশের কম। যদিও অর্থনীতিবিদ ও গবেষকেরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি করছেন।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত একটি দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়ে গেছে। বলা হয়, দক্ষতা বাড়ানো হয়নি, টাকা বেশি বরাদ্দ দিলেও খরচ করতে পারবে না। কিন্তু বহু বছর ধরে এ দুই খাতে প্রকল্পের টাকা খরচের সক্ষমতা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তাই এ দুই খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে দক্ষতা বাড়ানো উচিত। প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়াতে হলে যোগ্য জনবল দিতে হবে।’

কোন খাতে কত বরাদ্দ

সংশোধিত এডিপিতে মোটাদাগে ১৫টি খাত ৯১ শতাংশ বরাদ্দ পাচ্ছে। বরাদ্দের দিক থেকে এই ১৫ খাতের মধ্যে শীর্ষে আছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাত। এ খাতে বরাদ্দ থাকছে ৬৩ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা, যা সংশোধিত এডিপির প্রায় ২৬ শতাংশ। পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ২৫৮টি প্রকল্প আছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। এই খাতে বরাদ্দ ৩৭ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা, যা সংশোধিত এডিপির সাড়ে ১৫ শতাংশের সমান। তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ গৃহায়ণ ও কমিউনিটি সুবিধাবলি খাতে। এই খাত পাচ্ছে ২৮ হাজার ২ কোটি টাকা বা সংশোধিত এডিপির ১১ শতাংশ।

এ ছাড়া সংশোধিত এডিপিতে স্থানীয় সরকার ও পল্লি উন্নয়ন ১৯ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা, কৃষি ১০ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা, সাধারণ সরকারি সেবা ২ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা, প্রতিরক্ষা ৯২০ কোটি টাকা, জনশৃঙ্খলা ও সুরক্ষা খাত ৩ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা, শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা খাতে ৪ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ৩ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা, সামাজিক সুরক্ষায় ২ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা, ধর্ম, সংস্কৃতি ও বিনোদন খাতে ২ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা, পরিবেশ ও জলবায়ু খাতে ২ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।

সব মিলিয়ে সংশোধিত এডিপির আকার কমছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়য়ের আওতাধীন মূল এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সংশোধিত এডিপিতে বিদেশি সহায়তা থেকে কমছে ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ফলে বিদেশি সহায়তার পরিমাণ কমে দাঁড়াচ্ছে ৮৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর দেশজ উৎস থেকে বরাদ্দকৃত অর্থ কমছে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে দেশজ উৎসের বরাদ্দ কমে দাঁড়াচ্ছে ১ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতেও সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ কমানো হয়েছিল।

চলতি মাসে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তা ও প্রকল্প পরিচালকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম বিভাগ। সেখানে প্রকল্পের কর্মকর্তারা প্রকল্প সহায়তার পক্ষেই মত দিয়েছেন। তাদের মতামত ও বাস্তবায়ন সক্ষমতার ভিত্তিতে এডিপির আকার কমানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।