এলডিসি উত্তরণের প্রভাব
কৃষিপণ্য রপ্তানিতে ভর্তুকি শেষের চ্যালেঞ্জ, বিকল্প সুবিধার দাবি
এলডিসি-পরবর্তী বাস্তবতায় কৃষিপণ্য রপ্তানিতে নীতি সহায়তার তাগিদ।
প্রধান পাঁচ রপ্তানি পণ্য—বিস্কুট, নুডলস, ফলের জুস, পরোটা ও চানাপুর।
শীর্ষ পাঁচ রপ্তানি বাজার সৌদি আরব, আমিরাত, ভারত, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র।
দেশে প্যাকেটজাত খাবারের বাজার ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
সর্বশেষ ২০২৪–২৫ অর্থবছরে দেশ থেকে ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোাটি মার্কিন ডলারের কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে। রপ্তানিতে আরও বৈচিত্র্য আনতে ও পরিমাণ বাড়াতে সরকার খাতটিকে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ও সম্ভাবনাময় হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বর্তমানে ১৪৫টি দেশে সুগন্ধি চাল, ফল, সবজি, মাছ, মাংসের পাশাপাশি বিস্কুট, চানাচুর, নুডলস, জুস, মসলাসহ প্রায় ১৭২ ধরনের কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানি হচ্ছে।
তবে পুরোপুরি বিকশিত হওয়ার আগেই এলডিসি থেকে উত্তরণকে সামনে রেখে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে দেশের কৃষিপণ্য খাত। এলডিসি উত্তরণের পরে এ খাতের রপ্তানিতে সরকারের দেওয়া ২০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা বন্ধ হয়ে যাবে। একই সঙ্গে রপ্তানি বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারও বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে নতুন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা নিয়ে উদ্বিগ্ন এই খাতের ব্যবসায়ীরা। সে জন্য তাঁরা বিকল্প সুবিধার দাবি জানাচ্ছেন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, যথাযথ নীতি–সহায়তা বা বিকল্প ব্যবস্থা না নিলে এ খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে পারবে না। এ নিয়ে বাংলাদেশ অ্যাগ্রো-প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ইকতাদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, প্রণোদনা ও শুল্ক সুবিধা উঠে গেলে কৃষিপণ্য রপ্তানির পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমে যাবে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো কোনোমতে টিকে থাকতে পারলেও ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোর ঝরে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সরকার কী ধরনের বিকল্প সুবিধা দেবে, সে বিষয়ে এখনো কোনো স্পষ্টতা নেই।
কৃষিপণ্য রপ্তানিতে চলমান সুবিধাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নগদ সহায়তার পাশাপাশি এ খাতে সরকারের আরও বেশ কিছু সহায়তা রয়েছে। এর মধ্যে আছে ৫ থেকে ১০ বছরের জন্য করপোরেট করে ছাড়, বিদ্যুৎ বিলে ২০ শতাংশ ছাড়, রপ্তানি আয়ের ওপর ৫০ শতাংশ কর ছাড়, রপ্তানি পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি এবং মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ১ থেকে ৩ শতাংশ শুল্ক ছাড়। এ ছাড়া ২০টি পণ্যে ২০ শতাংশ অর্থায়ন এবং হালাল পণ্যে ২০ শতাংশ প্রণোদনাসহ বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। তবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এ ধরনের সহায়তা দেওয়া যাবে না। পাশাপাশি রপ্তানি বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারও বাধাগ্রস্ত হবে, যা উদ্যোক্তাদের জন্য দ্বিমুখী চাপ তৈরি করতে পারে।
গত ২০২৪–২৫ অর্থবছরে দেশ থেকে শুধু প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন বা ৪০০ কোটি ডলারের। দেশ থেকে রপ্তানি হয়ে থাকে মোট ১৭২ ধরনের কৃষিপণ্য। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হওয়া পাঁচটি পণ্য হলো বিস্কুট, নুডলস, ফলের জুস, পরোটা ও চানাপুর। শুধু বিস্কুটই রপ্তানি হয়েছে সাড়ে ৮৮ মিলিয়ন ডলারের। এই পাঁচ পণ্য মিলিয়ে মোট রপ্তানির প্রায় ৪৫ শতাংশ।
এই খাতের বড় রপ্তানিকারক প্রাণ গ্রুপ গত বছরে ৩১৫ মিলিয়ন বা সাড়ে ৩১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। তাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য ছিল মসলা। এলডিসি–পরবর্তী প্রস্তুতি সম্পর্কে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহসান খান চৌধুরী প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা প্রতিনিয়ত উৎপাদন ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছেন এবং নতুন নতুন বাজার অনুসন্ধান করছেন। এ ক্ষেত্রে সরকার বন্দর সুবিধা উন্নয়ন, ঋণের সুদহার হ্রাস ও জাহাজ ভাড়া কমানোর মাধ্যমে সহায়তা করতে পারে।
এলডিসি–পরবর্তী পাঁচ বছর রপ্তানি খাতগুলোর জন্য ভিন্নভাবে সহায়তার দাবি জানিয়ে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান তৌহিদুজ্জামান বলেন, সরকার কাঁচামাল আমদানিতে এবং গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিলে ছাড় দিতে পারে। তিনি বলেন, আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোতে বাংলাদেশি পণ্যে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক দিতে হয়, অথচ ভারত ও পাকিস্তান বিনা শুল্কে পণ্য রপ্তানি করতে পারছে। এসব শুল্কবাধা দূর করতে সরকার উদ্যোগ নিতে পারে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্যমতে, দেশে প্রক্রিয়াজাত পণ্যের বাজার ২০২৪ সালে ছিল ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের, যা ২০৩০ সালে বেড়ে ৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। দেশে প্যাকেটজাত খাবারের বাজার ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি। প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানিতে বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি ১৬ শতাংশের বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশ ৫২টি দেশে বাজারসুবিধা পেয়ে থাকে। এ খাতে প্রায় ২৫০টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বিশ্বে প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের বাজার ১৩ ট্রিলিয়ন বা ১৩ লাখ কোটি ডলারের বেশি, যার মধ্যে হালাল খাবারের বাজার ২ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন বা ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলার।
বিশাল এই বিশ্ববাজারে নতুন উদ্যোক্তাদের যুক্ত করার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দেশে অনেক ছোট উদ্যোক্তা রয়েছেন, যাঁদের যথাযথ সুবিধা দিয়ে রপ্তানি পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। সরকার তাঁদের বিদেশি মেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে পারে। পাশাপাশি স্বল্প সুদে ঋণ ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। তাঁর মতে, বিদেশি বিনিয়োগ এলে দেশীয় পণ্যের মানেও গুণগত পরিবর্তন আসবে।
দেশের রপ্তানি বৃদ্ধি ও বহুমুখীকরণ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিচালক আবু মোখলেছ আলমগীর প্রথম আলোকে জানান, বিকল্প সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে তাঁরা কাজ করছেন। এর মধ্যে রয়েছে পণ্যের মান উন্নয়নে গবেষণা, অবকাঠামো উন্নয়ন, কার্গো সুবিধা বৃদ্ধি এবং কুল চেইন ভ্যান নিশ্চিত করা ইত্যাদি। এ ছাড়া ইউটিলিটি বিল হ্রাস এবং করকাঠামো নিয়েও কাজ চলছে।
বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ১৪৫টি দেশে ১৭২ ধরনের কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানি করে। এর মধ্যে ১০৬টি দেশে প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানি হয়। এ খাতের প্রধান পাঁচ রপ্তানি পণ্যের বাজার হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), সৌদি আরব, ভারত, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। এই পাঁচ দেশেই মোট রপ্তানির প্রায় ৬০ শতাংশ যায়। সর্বোচ্চ প্রায় ৯৩ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয় ইউএইতে।