‘পূর্বাচল এখন ট্যাক্স হ্যাভেনে পরিণত হয়েছে’

‘সম্পদ কর আহরণের সুযোগ’ বিষয়ক সংলাপে বক্তব্য দেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। আজ রাজধানীর একটি হোটেলেছবি: প্রথম আলো

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, রাজধানীর পূর্বাচলে হাজার হাজার প্লট খালি পড়ে রয়েছে। কিন্তু সেখানে জমির মূল্য দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ, সেখানে জমি কিনছেন ধনী ব্যক্তিরা। কিন্তু এই জমির বিপরীতে তাঁদের কোনো কর দেওয়া লাগছে না। এভাবে পূর্বাচল তাঁদের জন্য একটি ট্যাক্স হ্যাভেনে (করের স্বর্গ) পরিণত হয়েছে।

‘সম্পদ কর আহরণের সুযোগ’ বিষয়ক সংলাপে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এই কথা বলেছেন। আজ বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে এই সংলাপের আয়োজন করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনের সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য দেন সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী, সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বাংলাদেশে আয়বৈষম্য বাড়ছে। কিন্তু সম্পদবৈষম্য তারচেয়েও বেশি বাড়ছে। এর মূল কারণ, আমাদের আয়ের চেয়ে জমি বা বাড়ির দাম খুব দ্রুত বাড়ছে। কিন্তু এসব সম্পদের ওপর তেমন একটা কর আরোপ করা হচ্ছে না।’

এ সময় রাজধানীর পূর্বাচল এলাকার উদাহরণ টেনে আহসান এইচ মনসুর বলেন, পূর্বাচলের দিকে ৩০০ ফুট সড়ক দিয়ে গেলে দেখা যাবে, সেখানে হাজার হাজার প্লট সব খালি। কিন্তু এসব জায়গার মূল্য খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১০ বছর আগে ৩ কাঠা জমির দাম ছিল ২৫ লাখ টাকা। পাঁচ বছর আগে ছিল ৭৫ লাখ। আজকে গেলে তিন কোটি টাকা। এই দ্রুত মূল্যবৃদ্ধির কারণ, জমির মালিকদের সম্পদের কর দেওয়া লাগছে না। এভাবে পূর্বচল একটা ট্যাক্স হ্যাভেনে পরিণত হয়েছে।

অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, বাংলাদেশে ধনীদের আয়ের মূল (বেসিক) উৎস হচ্ছে জমি। সরকারি আমলা কিংবা সামরিক কর্মকর্তা—তাঁরা অবসরের পরে সরকার থেকে জমি পাচ্ছেন। ফলে তাঁরা জমিকেন্দ্রিক সংস্কৃতির সুবিধাভোগী। কিন্তু এসব জমি উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, মাইলের পর মাইল খালি জমি পড়ে আছে।

ঢাকা শহরে ৩০ লাখ হাউজিং ইউনিটের চাহিদার বিপরীতে মাত্র ২৫–৩০ হাজার সরবরাহ আছে উল্লেখ করে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আবাসন সংকটের কারণে আমরা হিসাব করে দেখেছি, বস্তিতে প্রতি বর্গফুটে যে ভাড়া দেওয়া হয়, তা গুলশানের বাসাভাড়ার চেয়ে বেশি। এটা দুঃখজনক সত্য। সম্পদ কর আদায় হলে এ সমস্যা কমে আসবে।’

‘সম্পদ কর আহরণের সুযোগ’ বিষয়ক সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। আজ রাজধানীর একটি হোটেলে
ছবি: প্রথম আলো

আয়বৈষম্যের চেয়ে সম্পদের বৈষম্য দ্বিগুণ বেশি
মূল প্রবন্ধে সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক খানা আয়-ব্যয় জরিপ (এইচআইইএস) দেখিয়েছে, আয় বেড়েছে দ্বিগুণ। কিন্তু একই সঙ্গে আয়বৈষম্যও বেড়েছে। তবে আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, আয়বৈষম্যের চেয়ে সম্পদের বৈষম্য বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ বেশি।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সম্পদ কর আদায় করলে শুধু সামাজিক সাম্যই বাড়ে না, এর সঙ্গে অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতাও বৃদ্ধি পায়। আর দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সম্পদ করের প্রচলন বাধ্যতামূলক ও অবশ্যম্ভাবী হয়ে গেছে। তবে এটি ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে হতে হবে এবং উচ্চ হারে নির্ধারণ ঠিক হবে না।

এ ছাড়া উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে কর আরোপের প্রচলন করা জরুরি বলে মন্তব্য করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি প্রশ্ন করেন, উত্তরাধিকারের সম্পত্তির কর না দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যাওয়া কতটা ন্যায্য?

সরকারি প্রতিষ্ঠানের হাজার কোটি টাকা বকেয়া
ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ভূমিকর বাবদ হাজার হাজার কোটি টাকা বকেয়া রেখেছে। এখন আস্তে আস্তে কিছু কিছু সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু এখনো বহু টাকা বকেয়া আছে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, সরকারি শিল্প চলছে, কিন্তু গ্যাস বিল দিচ্ছে না। এভাবে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। তবে এভাবে আর চলতে পারে না।’

ভূমিমন্ত্রী আরও বলেন, ২০–২৫ বছর আগেও মানুষের ভূমি নিয়ে এত আগ্রহ ছিল না। এখন মানুষ ভূমির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করছেন। এই প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

করছাড়ে লাগাম টানার পরামর্শ
নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান স্নেহাশীষ, মাহমুদ অ্যান্ড কোম্পানির অংশীদার স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, সম্পদের মালিকানায় একধরনের পরিবর্তন হচ্ছে। ব্যক্তিমালিকানার পরিবর্তে এখন কোম্পানির নামে সম্পদ কেনা হচ্ছে। তাই সম্পদ কর আদায়ের ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে বিবেচনায় রাখার পরামর্শ দেন তিনি।

এ সময় করছাড়ের বিষয়ে একটি উদাহরণ দিয়ে স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, ‘২০১৯ সালে একটি বড় গ্রুপ অব কোম্পানি এক হাজার মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র করেছে। সেখানে তারা স্ট্যাম্প ডিউটিতে তিন হাজার কোটি টাকার ওপরে করছাড় পেয়েছে। তাহলে দেশে যদি বিদ্যুৎ খাতে ২০ হাজার মেগাওয়াটের পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়, তাহলে পুরো এই খাতে ৬০ হাজার কোটি টাকার করছাড় দেওয়া হয়েছে। তাহলে করছাড় কতখানি দেব সেটি নিয়ে ভাবতে হবে।’

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, সম্পদকে করের আওতায় আনা গেলে সম্পদ দখল ও সহিংসতা কমে আসবে। এ ছাড়া সম্পদ কেনার নামে অপ্রদর্শিত আয় সাদা করার প্রক্রিয়া বন্ধের উদ্যোগ নিতে পরামর্শ দেন তিনি।

এনবিআরের আরেক সাবেক চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, জমি নিবন্ধন ভূমি মন্ত্রণালয় ও মিউটেশন (নামজারি) আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে হয়। উভয় প্রক্রিয়াকে একটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, সরকার সর্বজনীন পেনশনের ব্যবস্থা শুরু করতে যাচ্ছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার শুরুটায় মনে হয় ভুল হয়ে গেছে। প্রথমে করদাতাদের নিয়ে শুরু করে পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে সবাইকে এর অধীনে নিয়ে এলে প্রক্রিয়াটা বেশি টেকসই হতো।