জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা

প্রত্যয় স্কিমে সুবিধা কারোরই কমবে না

‘বৈষম্যমূলক’ আখ্যায়িত করে নতুন চালু হওয়া পেনশন কর্মসূচি প্রত্যয়-এর বিরোধিতা করছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। ফেডারেশনের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ইতিমধ্যে বিদ্যমান পদ্ধতি ও প্রত্যয়ের মধ্যে তুলনামূলক চিত্রসংবলিত প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষকেরা যেসব প্রশ্ন তুলেছেন, সেগুলোর জবাব দিয়েছেন জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা। গতকাল সোমবার ঢাকার কাকরাইলে পেনশন কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি ফখরুল ইসলাম।

প্রথম আলো:

সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি প্রত্যয়-এর আওতায় রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ ইত্যাদি সংস্থায় নতুন নিয়োগ পাওয়া কর্মীদের বেতন থেকে টাকা কাটা হবে। অথচ বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় বেতন থেকে টাকা কাটা হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এ প্রশ্নের জবাবে কী বলবেন?

গোলাম মোস্তফা: দেখুন, বাংলাদেশ এখন জনসংখ্যার সুবিধা (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) ভোগ করছে। এ সুবিধা কিন্তু বছর বছর কমতে থাকবে। বাড়তে থাকবে বয়স্ক মানুষ। ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছি। সব মানুষ যাতে সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের মধ্যে থাকতে পারে, সে কারণেই সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থা ছাড়া সবার জন্য নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা সম্ভব নয়। উদারভাবে হিসাব করলে বর্তমানে সরকারি ১২ লাখ, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত ইত্যাদি সংস্থার ৪ লাখ এবং পেনশনে যাওয়া অবসরভোগী ৭ লাখ অর্থাৎ ২৩ লাখ লোক পেনশনের আওতাভুক্ত। একটি পরিবারের সদস্য চারজন ধরলে প্রায় এক কোটি মানুষ এখন পেনশনের সংস্পর্শে আছেন। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাটি করা হয়েছে সব মানুষের কথা মাথায় রেখে। সুতরাং, বিদ্যমান পদ্ধতির তুলনায় সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা অংশগ্রহণমূলক হবে, এটাই স্বাভাবিক।

প্রথম আলো:

বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা অবসরে যাওয়ার পর এককালীন ৮০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা আনুতোষিক পান। প্রত্যয় কর্মসূচিতে এককালীন কিছু থাকবে?

গোলাম মোস্তফা: পেনশনের ধারণার সঙ্গে এককালীন কিছু দেওয়ার বিষয়টি যায় না। আমি বলব, সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালু করে সরকার দূরদর্শী পদক্ষেপ নিয়েছে।

প্রথম আলো:

বিদ্যমান পদ্ধতিতে পেনশনভোগী ও নমিনি (স্বামী বা স্ত্রী) আজীবন পেনশন পাবেন। কিন্তু প্রত্যয়ে পেনশনভোগী আজীবন পেনশন পেলেও নমিনি পাবেন পেনশনভোগীর বয়স ৭৫ বছর হওয়া পর্যন্ত। এতে তাঁদের সুবিধা তো কমলই।

গোলাম মোস্তফা: বর্তমানে বিশ্বজুড়ে সাধারণত আনফান্ডেড, ফান্ডেড, ডিফাইন্ড বেনিফিটস (ডিবি), ডিফাইন্ড কন্ট্রিবিউশনস (ডিসি)—এই চার ধরনের পেনশন পদ্ধতি চালু রয়েছে। আনফান্ডেড পেনশনে কোনো কর্মীকে চাঁদা দিতে হয় না বলে এটির জন্য কোনো তহবিল সৃষ্টি হয় না। ফান্ডেড পেনশনে কর্মী বা প্রতিষ্ঠান বা উভয়কেই চাঁদা দিতে হয়। ডিবি পদ্ধতি সরকারি কর্মচারীদের জন্য। ডিসি পদ্ধতিতে কর্মী বা প্রতিষ্ঠান থেকে একটি তহবিলে অর্থ জমা হয় এবং সেখান থেকেই ব্যয় নির্বাহ করা হয়। কোনো কোনো দেশে অবশ্য বিমা কোম্পানির মাধ্যমেও পেনশনব্যবস্থা চালু আছে। এটা সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে যে বাংলাদেশে আর অনফান্ডেড পেনশন থাকবে না। নমিনিদের যে প্রশ্নটি এসেছে, বর্তমানে পেনশনভোগী মারা গেলে তাঁর স্বামী বা স্ত্রী আজীবন পেনশন পান। ক্ষেত্রবিশেষে তাঁদের প্রতিবন্ধী সন্তানও পান। এখন স্বামী বা স্ত্রীর পরিবর্তে নমিনি যিনি হবেন, তিনি পাবেন। বিশ্বচর্চাও এ রকমই। আনফান্ডেড ব্যবস্থা এখন কম দেশেই আছে।

প্রথম আলো:

বিদ্যমান ব্যবস্থায় পেনশন ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) পায়। নতুন ব্যবস্থায় এ বিষয়ে কিছু বলা নেই, তা তো ঠিক?

গোলাম মোস্তফা: বার্ষিক বৃদ্ধির বিষয়টি তো চালু হয়েছে মাত্র ২০১৭ সালে। আগে এটা ছিল না। নতুন ব্যবস্থায় বার্ষিক বৃদ্ধির কিছু থাকবে না। তবে কত হারে চাঁদা দিলে কত হারে পাওয়া যাবে, তার একটা আনুমানিক হিসাব দেওয়া আছে। আমাদের ধারণা, ভবিষ্যতে পেনশনের পরিমাণ আরও বাড়বে।

প্রথম আলো:

বর্তমানে অর্জিত ছুটির বিপরীতে যে টাকা পাওয়া যায়, এ নিয়ে তো কিছু বলা নেই।

গোলাম মোস্তফা: এগুলো আগের মতোই থাকবে। অর্থাৎ, বাদ দেওয়া হয়নি। হয়তো বিভাজন করে দেখানো হচ্ছে না। তবে সুবিধা কারোরই কমবে না।

প্রথম আলো:

শিক্ষকদের অবসরের বয়স ৬৫, কর্মকর্তাদের ৬২ এবং কর্মচারীদের ৬০ বছর। নতুন ব্যবস্থায় ৬০ বছর পর থেকে পেনশন পাওয়া যাবে। শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের অবসরে যাওয়ার বয়সসীমাও কি ৬০ বছরে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে?

গোলাম মোস্তফা: এগুলো তো মামুলি বিষয়। কারও অবসরের বয়সসীমাই কমানোর পরিকল্পনা সরকারের নেই। গড় আয়ু বাড়ছে। বরং যাঁদের অবসরের বয়সসীমা কম আছে, তাঁদেরও বৃদ্ধির সুযোগ আছে।

প্রথম আলো:

শিক্ষকেরা বর্তমানে মাসিক চিকিৎসা ভাতা, দুটি উৎসব ভাতা ও একটি বৈশাখী ভাতা পেয়ে থাকেন। নতুন ব্যবস্থায় এ নিয়ে কিছু উল্লেখ না থাকার কারণ কী?

গোলাম মোস্তফা: এতে কি তাঁরা বেশি টাকা পান? তবে এটুকু বলতে পারি যে চূড়ান্ত বিচারে কারও সুবিধাই কমবে না। প্রত্যয় চালু হলে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসবেন না বলে একধরনের আশঙ্কার কথা শোনা হচ্ছে। এটা ঠিক নয়। সত্যি কথা বলতে গেলে মেধাবী ব্যক্তি সব শ্রেণি-পেশাতেই আছেন। এটা আসলে ব্যক্তির পছন্দের বিষয়। অনেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েও শিক্ষকতা পেশায় যান না। কেউ আছেন বিসিএসে চাকরি পেয়েও তা ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা করছেন। কেউ সাংবাদিকতাও করছেন। পড়াশোনা বেশি না করেও অনেক ঝড়-ঝাপটা সহ্য করে কেউ শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। তাঁকে কি আপনি কম মেধাবী বলবেন? সুতরাং, এটা কোনো কাজের কথা না। কোনো বিশেষ শ্রেণি-পেশার জনগোষ্ঠীর বদলে আমরা চাই দেশের সব মানুষের জীবনের সুরক্ষা। সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালুর উদ্দেশ্যও তাই।

প্রথম আলো:

তাহলে কি প্রত্যয় চালুর মাধ্যমে কোনো বৈষম্য তৈরি করা হচ্ছে না?

গোলাম মোস্তফা: কার সঙ্গে বৈষম্য? ১ জুলাইয়ের আগে যাঁরা বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থার মধ্যে আছেন, তাঁদের সঙ্গে? নাকি সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে? কোনো ধরনের বৈষম্যমূলক কিছু হচ্ছে না। আগামী বছরের ১ জুলাই থেকে তো নতুন নিয়োগ পাওয়া সরকারি কর্মচারীরাও সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার মধ্যে আসছেন। এ নিয়ে আর বেশি কিছু বলার নেই।

প্রথম আলো:

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সদস্য সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিগুলো যে প্রত্যয় বাতিলের দাবিতে ক্লাস, পরীক্ষাসহ সব ধরনের কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে, এ বিষয়ে কী বলবেন?

গোলাম মোস্তফা: জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারী দপ্তর। তাঁদের কিছু বলার থাকলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নয়, অর্থ মন্ত্রণালয়ে গিয়ে বলবেন। যেহেতু সিদ্ধান্তটি নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

প্রথম আলো:

সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

গোলাম মোস্তফা: আপনাকেও ধন্যবাদ।