বাজেটে উল্টো বাড়ছে ভর্তুকি, কোন খাতে কত বরাদ্দ হতে পারে

আসছে বাজেট ২০২৪–২৫

ভর্তুকি কমাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ রয়েছে। অন্যদিকে বেশি ভর্তুকি দেওয়ার মতো অবস্থায়ও নেই সরকার। অর্থসংকটের কারণে সার ও বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকির টাকা পরিশোধ করতে না পেরে সরকার কয়েক হাজার কোটি টাকার বন্ড দিয়েছে। তারপরও আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাড়ছে ভর্তুকি ও প্রণোদনার পরিমাণ। অর্থাৎ বছর ঘুরলেই ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি যে অনেকটা নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে মূল বরাদ্দ থেকে বাড়িয়ে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ বরাদ্দের প্রস্তাব ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা করার পরিকল্পনা করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। অবশ্য চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ সংশোধিত বাজেট বরাদ্দ ৯৮ হাজার কোটি টাকাকে ভিত্তি ধরলে এই বৃদ্ধি হতে পারে অন্তত ১৪ হাজার কোটি টাকা। অর্থ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

আইএমএফের পরামর্শে সরকার এরই মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে হাত দিয়েছে। যেমন বিদ্যুতের দাম বছরে চারবার বাড়িয়ে এ খাতে ভর্তুকি কমিয়ে আনা। এ ছাড়া রপ্তানিতে প্রণোদনা কমানোর লক্ষ্যে আইএমএফের পরামর্শ ও অর্থ বিভাগের সিদ্ধান্ত শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।

সূত্রগুলো জানায়, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হওয়ার পর উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিভিন্ন খাতে বেশি ভর্তুকি দেওয়া যাবে না। একই সঙ্গে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমানোর জন্য জোরালো পরামর্শ দিয়ে আসছে আইএমএফ। ফলে আগে থেকেই সতর্ক পদক্ষেপ নেওয়ার চিন্তা করেছিল অর্থ বিভাগ। কিন্তু যথাযথ ভর্তুকি ব্যবস্থাপনা তৈরি করতে না পারায় গতানুগতিকভাবেই ভর্তুকি বাড়ানোর পথে রয়েছে সরকার।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি খাতে মূল বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। আইএমএফের পরামর্শে সরকার এরই মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে হাত দিয়েছে। যেমন বিদ্যুতের দাম বছরে চারবার বাড়িয়ে এ খাতে ভর্তুকি কমিয়ে আনা। এ ছাড়া রপ্তানিতে প্রণোদনা কমানোর লক্ষ্যে আইএমএফের পরামর্শ ও অর্থ বিভাগের সিদ্ধান্ত শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।

আরও পড়ুন

এ ছাড়া তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম আন্তর্জাতিক বাজারে এক বছর আগের তুলনায় অর্ধেকে নেমেছে। প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে জ্বালানি তেলে ভর্তুকিও। তবে তারপরও বাড়ানো হচ্ছে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ। জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপনের আগে বরাদ্দ অবশ্য আরেকটু বাড়তে বা কমতে পারে বলে জানান অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।

অর্থ বিভাগের একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা বলেন, ভর্তুকি যেমন কমাতে হবে, ভর্তুকি আবার দিতেও হবে। এখনই সবকিছু থেকে পুরোপুরি ভর্তুকি তুলে দেওয়ার সময় আসেনি। আর ২০২৬ সালের মধ্যে ঠিকই ভর্তুকি কমিয়ে আনার একটা ব্যবস্থা করা হবে।

আগামী অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি ৩৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ দেওয়া হতে পারে বিদ্যুৎ খাতে। আর কৃষি খাত বরাদ্দ পেতে পারে ২৫ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া রপ্তানি প্রণোদনায় ৭ হাজার ৮২৫ কোটি, এলএনজি আমদানিতে ৭ হাজার কোটি, খাদ্যে ৭ হাজার কোটি, প্রবাসী আয় আনায় ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে।

কোন খাতে কত ভর্তুকি হতে পারে

আইএমএফ একদিকে যেমন সরকারকে ভর্তুকি কমিয়ে আনতে পরামর্শ দিয়েছে, অন্যদিকে সরকারও অর্থসংকটের কারণে ভর্তুকির অর্থ পরিশোধ করতে পারছে না। বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে ভর্তুকির টাকা পরিশোধ করতে না পেরে সরকার ইতিমধ্যে ১৫ হাজার কোটি টাকার বন্ড দিয়েছে।

সূত্রমতে, আগামী অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি ৩৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ দেওয়া হতে পারে বিদ্যুৎ খাতে। আর কৃষি খাত বরাদ্দ পেতে পারে ২৫ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া রপ্তানি প্রণোদনায় ৭ হাজার ৮২৫ কোটি, এলএনজি আমদানিতে ৭ হাজার কোটি, খাদ্যে ৭ হাজার কোটি, প্রবাসী আয় আনায় ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে। মোট ভর্তুকি কমিয়ে আনতে নতুন করে সার, পানি এমনকি এলএনজির মূল্যবৃদ্ধির সুপারিশ করা হতে পারে।

ভর্তুকির টাকা হলো জনগণের দেওয়া করের টাকা। আর আইএমএফের অর্থ খরচে যে যৌক্তিকীকরণ চাইছে, তার মানে হলো ভর্তুকি কমানো।

সূত্রগুলো জানায়, গত মাসে অনুষ্ঠিত আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার-সংক্রান্ত সমন্বয় কাউন্সিল ও সম্পদ কমিটির বৈঠকে অঙ্কগুলো চূড়ান্ত করা হয়। একই বৈঠকে ভর্তুকি ব্যবস্থাপনায় যৌক্তিকীকরণ বিষয়ে আইএমএফের চাওয়া নিয়েও আলোচনা হয়।

ভর্তুকির টাকা হলো জনগণের দেওয়া করের টাকা। আর আইএমএফের অর্থ খরচে যে যৌক্তিকীকরণ চাইছে, তার মানে হলো ভর্তুকি কমানো। অর্থনীতিবিদদের মতে, ভর্তুকি কম হলে সরকারের জন্যও ভালো। কারণ, এ টাকা তখন অন্য কাজে ব্যয় করা যায়। ভর্তুকি কমলে দেশের সামাজিক ও উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য আরও অর্থায়নের সুযোগ তৈরি হয়। বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের আগে আইএমএফ এ কথা বলেছে।

ভর্তুকি কমিয়ে আনতেই হবে। এ ছাড়া উপায় নেই। যেহেতু ভর্তুকি কমানোর লক্ষ্যে বিদ্যুৎসহ কয়েকটি খাতে এখন ইতিবাচক সূচক দেখা যাচ্ছ, ফলে ভর্তুকি কমে আসাটাই সংগত। তারপরও আমার প্রশ্ন, যে ভর্তুকি রাখা হচ্ছে, তার মধ্যে কি আগের বকেয়া পরিশোধ করার অর্থ থাকছে? যদি থাকে, তাহলে ভালো। প্রকৃত বিচার বা টাকার মূল্যমানের বিচারে ভর্তুকি তখন বাড়বে না। না থাকলে সরকারের এ ব্যাপারে স্পষ্টীকরণ দরকার।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর

ভর্তুকি ও প্রণোদনার বাইরে নগদ ঋণ ও অগ্রিমকেও ভর্তুকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আগামী অর্থবছরের বাজেটে আর্থিক প্রতিষ্ঠানবহির্ভূত সংস্থাগুলোকে ঋণ দিতে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন, পাটকল করপোরেশন ইত্যাদিকে ঋণ দেওয়া হলেও এ টাকা সরকার আর ফেরত পায় না। ফলে এগুলোর জন্য বরাদ্দও একধরনের ভর্তুকি।

ভর্তুকি দেওয়ার অসুবিধা নিয়ে অর্থ বিভাগেরই এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভর্তুকি দেওয়া হলে বাজার অর্থনীতির চালিকা শক্তি অর্থাৎ চাহিদা ও জোগানের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য নির্ধারিত হয় না এবং সুবিধাপ্রাপ্ত খাতগুলো প্রতিযোগিতামূলক বাজারে আসার দক্ষতা হারায়। এদিকে ভর্তুকির সুবিধাপ্রাপ্ত খাত বাজার অর্থনীতিতে নিজেদের প্রতিযোগী হিসেবে গড়ে তোলে না এবং ভর্তুকিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করে ফেলে। ভর্তুকির কারণে দুর্নীতি বাড়ে এবং উন্নয়নমূলক কাজে বিনিয়োগ কমে যায়।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ভর্তুকি কমিয়ে আনতেই হবে। এ ছাড়া উপায় নেই। যেহেতু ভর্তুকি কমানোর লক্ষ্যে বিদ্যুৎসহ কয়েকটি খাতে এখন ইতিবাচক সূচক দেখা যাচ্ছ, ফলে ভর্তুকি কমে আসাটাই সংগত। তারপরও আমার প্রশ্ন, যে ভর্তুকি রাখা হচ্ছে, তার মধ্যে কি আগের বকেয়া পরিশোধ করার অর্থ থাকছে? যদি থাকে, তাহলে ভালো। প্রকৃত বিচার বা টাকার মূল্যমানের বিচারে ভর্তুকি তখন বাড়বে না। না থাকলে সরকারের এ ব্যাপারে স্পষ্টীকরণ দরকার।’