সরকারি হিসাবেই মূল্যস্ফীতি এখন ৯ শতাংশের বেশি

প্রধানমন্ত্রীর কাছে সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উপস্থাপন করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা আছে বলে মনে করেন পরিকল্পনামন্ত্রী।

অবশেষে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসের মূল্যস্ফীতির তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে জানা গেল। ওই দুই মাসে ৯ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি হয়েছে। এত দিন শুধু খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি নিয়েই বেশি চিন্তা ছিল। এখন খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবার মূল্যস্ফীতি নিয়েও চিন্তা বেড়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত—দুই ধরনের পণ্যেই মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের বেশি হয়েছে। খাদ্যের চেয়ে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি বেশি।

জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে গতকাল মঙ্গলবার মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির তথ্য তৈরি করে থাকে। গত আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ হয়েছে। আর সেপ্টেম্বর মাসে তা কিছুটা কমে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ হয়েছে।

আগস্ট মাসে গত ১১ বছর ৩ মাসের (১৩৫ মাস) মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ২০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। ২০১১ সালের মে মাসের পর মূল্যস্ফীতি আর কখনো ৯ শতাংশের বেশি হয়নি।

মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে পরিকল্পনামন্ত্রী এম মান্নান বলেন, সার্বিক পরিস্থিতির কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সব পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। তবে এখন মূল্যস্ফীতি কমতির দিকে। সামনে তা আরও কমবে। তিনি আরও বলেন, ‘স্বস্তির বিষয় হলো, মজুরি হার কিছুটা বেড়েছে। আগস্ট মাসে জাতীয় মজুরি হার ছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ, সেপ্টেম্বর মাসে তা কিছুটা বেড়ে ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ হয়েছে। মোটা চালের দাম ৫০-৫৫ থেকে ৪২-৪৩ টাকায় নেমেছে বলে গ্রামের মানুষ জানিয়েছেন।’

গত আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে পেট্রল, অকটেন, ডিজেলসহ জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সব জিনিসের দাম বেড়ে যায়। আবার পরিবহনভাড়াও বৃদ্ধি পায়। এসব কারণে আগস্ট মাসে উচ্চ মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা করেছিলেন অর্থনীতিবিদেরা। কিন্তু মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় ওই মাসের তথ্য প্রকাশ করেনি বিবিএস। এখন আগস্ট ও সেপ্টেম্বর—এই দুই মাসের তথ্য একসঙ্গে প্রকাশ করা হলো।

মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি হিসাবেই মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে আছে। বাস্তবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বেশি পড়ছে। এটা বড় উদ্বেগের বিষয়। এখন অর্থনীতির বড় সংকটের একটি হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি।’

দুই সূচকেই মূল্যস্ফীতি বেশি

গত সেপ্টেম্বর মাসে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত—দুই ক্ষেত্রেই মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি হয়েছে। শঙ্কার বিষয় হলো, সেপ্টেম্বর মাসে খাদ্যের চেয়ে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতির হার বেশি। গত মাসে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ থেকে কমে ৯ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ হয়েছে। অন্যদিকে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি আগস্ট মাসের ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ হয়েছে।

দুই মাস ধরে গ্রাম-শহরনির্বিশেষ মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি আছে। গত সেপ্টেম্বরে শহরে মূল্যস্ফীতি কমেছে, গ্রামে বেড়েছে। গত মাসে গ্রাম এলাকায় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ এবং শহরে এই হার ৯ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।

এ বিষয়ে সেলিম রায়হান বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা ও পরিমাণ—দুটোই বৃদ্ধি করা উচিত। সরকার যে এক কোটি পরিবারকে ফ্যামিলি কার্ড দিচ্ছে, এই সংখ্যা বাড়ানো দরকার। যে পরিমাণ পণ্য দেওয়া হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম। গরিব মানুষের আয় বাড়ছে না। তাঁর মতে, এই মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ না নেওয়াই উচিত। যখন মূল্যস্ফীতি কমবে, তখন এই উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

‘দুঃসময় পার করছি’

গতকালের একনেক সভায় দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘সভায় প্রধানমন্ত্রীর সামনে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরেছি। বৈশ্বিক অবস্থাও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যেসব আভাস দিচ্ছে, তাও তুলে ধরা হয়েছে। আমরা একটা দুঃসময়ের মতো পার করছি। আমরা ছোট অর্থনীতির দেশ হলেও বড় অর্থনীতির প্রভাব পড়ছে। অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা আছে। কিন্তু বড় অর্থনীতির তুলনায় ভালো আছি।’

অন্যদিকে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, অর্থনীতি উজ্জীবিত অবস্থায় আছে। গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে প্রবাসী আয় আগের প্রান্তিকের তুলনায় ৪ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। একইভাবে রপ্তানি বেড়েছে ১৩ দশমিক ১ শতাংশ। গত প্রান্তিকে আমদানি কমেছে ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ।

আমদানি কমানোর সরকারের নীতি সঠিকভাবে কাজ করছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রা সরবরাহ কমানো হয়েছে। গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় মুদ্রা সরবরাহের প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে। সরকারের প্রকৃত ঋণ নেওয়ার পরিমাণও আগের তুলনায় কমেছে।

১ জুলাই থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা সরকার ঋণ নিয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৫ হাজার ১০৮ কোটি টাকা। তিনি বলেন, সরকারে নেওয়া পদক্ষেপগুলো সঠিকভাবে কাজ করায় মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে। ভবিষ্যতে আরও কমবে।