ধেয়ে আসছে আরেকটি মন্দা, পুরস্কারেও তার ছাপ

নোবেল কমিটি যখন ঘোষণা করল, এ বছর অর্থনীতিতে পুরস্কার পাচ্ছেন বেন বার্নানকে, ডগলাস ডায়মন্ড ও ফিলিপ ডিবভিগ, তখন কিন্তু প্রকারান্তরে আরেকটি সত্য স্বীকার করে নেওয়া হলো। সেটি হলো, এ পুরস্কার মূলত দুঃসময়কে স্বীকার করে নিচ্ছে। আমেরিকার সাব-প্রাইম সংকট থেকে তৈরি হওয়া মন্দার ধাক্কা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই দুনিয়া আরও একটি মন্দার খাদের কিনারায় চলে এসেছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সর্বশেষ পূর্বাভাস, ২০২২ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি দাঁড়াতে পারে ৩ দশমিক ২ শতাংশ, ২০২১ সালে যা ছিল ৬ শতাংশ। এরপর ২০২৩ সালে তা আরও কমে দাঁড়ায় ২ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০০১ সালের পর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার আর কখনোই এতটা কমেনি, আর্থিক সংকট ও মহামারির চূড়ান্ত সময় ছাড়া। অথচ একই সময় বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধি পাবে। ২০২১ সালে মহামারির সময় যা ছিল ৪ দশমিক ৭ শতাংশ, ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও নিম্ন প্রবৃদ্ধির যুগে প্রবেশ করছে বিশ্ব, যাকে বলে স্ট্যাগফ্লেশন।

মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছিল, সেই ক্ষত নিরাময় তো হয়নি, উল্টো রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ আরেক গভীর বিপদ তৈরি করেছে। বিশ্বব্যাংক বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল—সবারই আশঙ্কা, অদূর ভবিষ্যতে আরও একটি মন্দা অপেক্ষা করছে।

এখন কথা হচ্ছে, মন্দার সঙ্গে ব্যাংকিং ব্যবস্থার সম্পর্ক কী? প্রচলিত ধারণা ছিল, মন্দার কারণে ব্যাংক ধসে যেতে পারে। ১৯২৯-৩৩-এর মহামন্দায় একের পর এক ব্যাংকের ধসে পড়াকে সেই সম্পর্কের সাক্ষী নজির হিসেবে দেখানো হতো। এ বছর অর্থনীতির অন্যতম নোবেলজয়ী বেন বার্নানকে মহামন্দার সময়ের বিপুল তথ্য ও পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন, ব্যাংক ধসে পড়া মন্দার ফলাফল নয়, বরং অন্যতম কারণ।

১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকের সেই গবেষণায় নোবেল কমিটি স্বীকৃতি জানিয়েছে। ঐতিহাসিক তথ্য ঘেঁটে বার্নানকে যে আখ্যান তৈরি করেছেন, তার যুক্তি জটিল নয়। ব্যাংক ব্যর্থ হয় বিশ্বাসের অভাবে। অর্থাৎ মানুষ যখন বিশ্বাস করতে পারে না, ব্যাংক তাদের জমানো টাকা ফেরত দিতে পারবে, তখন সবাই টাকা তুলে নিতে ব্যাংকে ছোটে। সব গ্রাহক একই সঙ্গে টাকা ফেরত চাইলে তা দেওয়ার উপায় নেই ব্যাংকের। কারণ, সেই টাকাই ঋণ হিসেবে দেওয়া রয়েছে। অতএব সবাই একসঙ্গে টাকা তুলে নিতে চাইলে শেষ পর্যন্ত ঝাঁপ ফেলা ছাড়া ব্যাংকের উপায় নেই। একটি ব্যাংক ব্যর্থ হলে অন্যান্য ব্যাংকের স্বাস্থ্য নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয় গ্রাহকের মনে। ফলে সেখানেও কালক্রমে একই ঘটনা ঘটে। বার্নানকে দেখিয়েছেন, মহামন্দার সময় এ আশঙ্কাতেই ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেওয়ার বদলে আমানতের টাকা বিনিয়োগ করেছিল এমন সম্পদে, যা থেকে সহজেই টাকা তুলে নেওয়া যায়। ফলে উৎপাদনশীল বিনিয়োগের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছিল। ফলে ধাক্কা লেগেছিল জিডিপির অঙ্কে, মন্দা গভীরতর হয়েছিল। এই ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন ঘটেছিল ২০০৮ সালের মন্দায়। বার্নানকে তখন আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভের কর্ণধার। গভীর খাদে পড়া ব্যাংকগুলোকে ‘বেইল আউট’ করেছিল সরকার। তৈরি হয়েছিল একটি নতুন বাক্যবন্ধ—‘টু বিগ টু ফেল’। অর্থাৎ এত বড় যে তারা ব্যর্থ হতে পারে না।

ডায়মন্ড ও ডিবভিগের গবেষণাও প্রায় চার দশকের পুরোনো। তাঁদের গবেষণার মূল কথাটিও সহজবোধ্য, গাণিতিক জটিলতাহীন। আমানতকারীরা চান, ব্যাংক থেকে তাঁরা যেন ইচ্ছেমতো তাঁদের গচ্ছিত অর্থ তুলে নিতে পারেন। অন্য দিকে ঋণগ্রাহকেরা এ নিশ্চয়তা চান, নির্দিষ্ট মেয়াদের আগে তাঁদের ঋণের টাকা ফেরত দিতে হবে না। অর্থাৎ চরিত্রগতভাবে স্বল্পমেয়াদি আমানত ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ—এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই ব্যাংকের কাজ। কাজটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যাংক না থাকলে টাকা জমানো বা বিনিয়োগ করা ও ঋণ গ্রহণ—দুটি কাজই খুব কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল হতো। ডায়মন্ড ও ডিবভিগ ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মানুষের আস্থা বজায় রাখার জন্য সরকারি গ্যারান্টির পক্ষেও জোরালো অবস্থান নিয়েছিলেন। এই তিন অর্থনীতিবিদের কাজকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে নোবেল কমিটি একই সঙ্গে ব্যাংকের গুরুত্ব ও আর্থিক সংকটের সময় সরকারের ভূমিকার কথাই স্মরণ করিয়ে দিল।

ব্যাংকের পুঁজি বেড়েছে

নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পর ব্রুকিংস ইনস্টিটিউট বেন বার্নানকের সম্মানে বক্তৃতা অনুষ্ঠান আয়োজন করে। বক্তৃতায় বার্নানকে বলেন, ২০০৮ সালের সংকট আর এখনকার সংকট এক নয়। ভালো খবর হলো, ব্যাংকের পুঁজি আগের চেয়ে বেড়েছে। ফলে ব্যাংকগুলো এখন যে চ্যালেঞ্জের মুখেই পড়ুক না কেন, তা মোকাবিলায় ব্যাংক এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রস্তুত। তবে তিনি লক্ষ করেছেন, ইদানীং ‘ব্যাংক’ শব্দটি অনেক ঢিলেঢালাভাবে ব্যবহৃত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংক–বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ছায়া ব্যাংকগুলো আর্থিক খাতে আরও বড় ভূমিকা পালন করে। তাঁর মত, এই ব্যাংক–বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দিকেও নজর দিতে হবে। কারণ, ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের সময় এসব প্রতিষ্ঠানও বড় ভূমিকা পালন করেছিল।

বার্নানকের মত, বিশ্বের অনেক দেশের আর্থিক খাত অস্থিতিশীল হলেও ২০০৮ সালের সংকট আর এখনকার সংকট এক নয়। মহামারির সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং খাত যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশেই আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। ডলারের দর বাড়ায় অনেক উদীয়মান দেশ বিপাকে পড়েছে, আবার অনেক দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে—এসব বড় মাথাব্যথার কারণ বলে মনে করেন তিনি।