ব্যবসার কঠিন সময়ে করের চাপ 

বৈশ্বিক ও দেশীয় পরিস্থিতিতে ব্যবসা চাপে রয়েছে। এমন সময় ছাড় তো নেই, উল্টো কর বেড়েছে বিভিন্ন খাতে। 

দেশে কত মুঠোফোন উৎপাদিত হয়, তার মাসভিত্তিক হিসাব থাকে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কাছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পর বিটিআরসির ওয়েবসাইটে ঢুঁ মেরে দেখা গেল, মুঠোফোন উৎপাদন কমছে। 

যেমন ২০২২ সালের এপ্রিলে দেশে মুঠোফোন উৎপাদিত হয়েছিল প্রায় ৩৪ লাখ। গত এপ্রিলে সেটা কমে প্রায় ১৫ লাখে নেমেছে। উৎপাদন কমার প্রবণতাটি ধারাবাহিক। 

মুঠোফোন উৎপাদনকারীরা যখন বিদেশ থেকে যন্ত্রাংশ আমদানিতে মার্কিন ডলারের সংকট ও মূল্যবৃদ্ধি এবং দেশে চাহিদা কমে যাওয়া নিয়ে বিপাকে রয়েছেন, তখন মুঠোফোন উৎপাদন ও সংযোজনে মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) আরোপ করেছেন অথবা বাড়িয়েছেন দুই থেকে আড়াই শতাংশ। 

সরকারের করসুবিধা দেখে দেশে মুঠোফোন তৈরির প্রায় ১৪টি কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় দেশি ব্র্যান্ডের মুঠোফোন তৈরি ও সংযোজিত হয়, আবার বিদেশি ব্র্যান্ডের মুঠোফোনও দেশে তৈরি হচ্ছে। ব্যবসা এখন কেমন যাচ্ছে, সামনের দিনগুলোর পূর্বাভাস কী, জানতে চেয়েছিলাম মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব জাকারিয়া শহীদের কাছে। তিনি বলেন, ব্যবসার খুবই বাজে অবস্থা। একদিকে ঋণপত্র খোলা কঠিন হয়েছে, যন্ত্রাংশের দাম বেড়েছে, অন্যদিকে চাহিদা কমেছে। সার্বিকভাবে বেচাকেনা এখন ৪০ শতাংশ কম। সেটা বিটিআরসির পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যাবে। 

জাকারিয়া শহীদ আরও বলেন, এখন আবার ভ্যাট বাড়ল। সব মিলিয়ে ব্যবসা হুমকির মুখে পড়ে গেল। 

মুঠোফোনের মতো কিছু পণ্যে এবারের বাজেটে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। কিছু কিছু খাতের সুরক্ষা কমানো হয়েছে। বাজেট নিয়ে এসব খাত অসন্তুষ্ট। মোটা দাগে ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজেটে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিদ্যমান পরিস্থিতির কোনো ছাপ নেই। ব্যবসা সংকটে রয়েছে, এ অবস্থায় স্বস্তির কোনো উদ্যোগ নেই বাজেটে; বরং মুনাফা না হলেও ন্যূনতম আয়কর প্রদান, অগ্রিম কর (এটি) আদায় ও পরে ফেরত না দেওয়ার মতো ‘অন্যায্য’ যে বিধিবিধানগুলো রয়েছে, সেগুলো রেখে দেওয়া হয়েছে। 

কিছু কিছু খাতে ভ্যাট ও কর অবকাশের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। সেটাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তবে তাঁরা চান, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় সংকটে থাকা খাতগুলোকে অগ্রিম কর ও ন্যূনতম করে কিছুটা ছাড় দেওয়া উচিত। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ব্যবসায়ী পরিস্থিতিটি তুলে ধরেন এভাবে—এক বছরে ডলারের দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশের মতো। দেশে শিল্প খাতে গ্যাসের দাম বেড়েছে ১৬০ শতাংশের বেশি। বিদ্যুতের দাম বেড়েছে তিন দফায় ৫ শতাংশ করে। সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ ২০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। কিন্তু পণ্যমূল্য বেড়েছে ১৫ শতাংশের মতো। এতে কোম্পানি এখন মুনাফায় নেই। তারপরও তাঁকে মোট বিক্রির ওপর শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ ন্যূনতম কর দিতে হচ্ছে। 

ওই ব্যবসায়ী বলেন, যেহেতু পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে টাকার অঙ্কে বিক্রির পরিমাণ বেড়েছে; সরকারও তার ওপর ভিত্তি করে কর নিচ্ছে। কিন্তু কোম্পানি লোকসানে চলে গেছে। তিনি বলেন, মুনাফা না হলেও আয়কর নেওয়াটা অন্যায্য।

চাপে পড়বে কোন কোন খাত

শুল্ক-কর ও ভ্যাট আরোপ অথবা বাড়ানোর কারণে চাপে পড়বেন বলপয়েন্ট কলম উৎপাদনকারী, সফটওয়্যার সেবাদানকারী তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি, তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) সিলিন্ডার উৎপাদনকারী, প্লাস্টিকের তৈজসপত্রের কারখানা, অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্রের কারখানা, টিস্যু শিল্প ও চশমা ব্যবসায়ীরা। 

স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে বিদেশি পণ্য আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক ও সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে বাজেটে। কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হতে হলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধিবিধানের সঙ্গে সংগতি রেখে শুল্ক যৌক্তিক করতে হয়। অর্থাৎ দেশীয় শিল্পের সুরক্ষা কমিয়ে প্রতিযোগিতায় নামাতে হয়। এরই অংশ হিসেবে বাজেটে ২৩৪টি পণ্যের সম্পূরক শুল্ক ও ১৯১টি পণ্যের নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে। 

ব্যবসায়ীরা বলছেন, এর প্রথম ধাক্কাটি লাগবে অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী পোশাক কারখানার ওপর। কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শুল্ক কমানো হয়েছে পোশাকের ওপর। এখন থাইল্যান্ড থেকে আসা ছেলেদের পোশাক ও ভারত থেকে আসা মেয়েদের পোশাকের দাম কমবে। অবশ্য আরেকটি মত হলো, দীর্ঘকাল কোনো খাতে সুরক্ষা রাখা উচিত নয়। 

আর কী কী আছে

বাজেটে একের অধিক গাড়ি থাকলে পরিবেশ সারচার্জের কথা বলা হয়েছে। এই সারচার্জ শুধু ব্যক্তি করদাতার ওপর, নাকি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও এর আওতায় পড়বে, তা স্পষ্ট নয় বলে জানিয়েছেন সনদধারী একজন হিসাববিদ। তিনি বলেছেন, এটা যদি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ওপরও আরোপ হয়, তাহলে ব্যবসার খরচ বাড়বে।

ভ্যাট আদায়ের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিপুল পরিমাণ ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) কিনে ব্যবসায়ীদের দেবে। এটা করা হলে বহু দোকান ভ্যাট দিতে বাধ্য হবে এবং ফাঁকিও রোধ হবে। 

ভ্যাট নির্ধারণের ক্ষেত্রে কর কর্মকর্তাদের ক্ষমতার বিন্যাস করা হয়েছে বাজেটে। রাজস্ব কর্মকর্তা ৫ লাখ, সহকারী কমিশনার ২০ লাখ, উপকমিশনার ৩০ লাখ, যুগ্ম কমিশনার ৫০ লাখ, অতিরিক্ত কমিশনার ১ কোটি এবং কমিশনার ১ কোটি টাকার বেশি পরিমাণের ভ্যাটের ক্ষেত্রে ন্যায় নির্ণয়ের ক্ষমতা পেয়েছেন। 

 হিসাববিদেরা বলছেন, এতে ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি ও সময় ব্যয় কমবে। ছোট বিরোধ নিচের স্তরেই নিষ্পত্তি হবে। তবে সমস্যা হলো অসাধু কর্মকর্তারা ক্ষমতা পেয়ে দুর্নীতি ও হয়রানি বাড়িয়ে দিতে পারেন।

‘এটা চোখ বুজে থাকা’

সার্বিকভাবে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বিশাল বাজেটে কর আদায়ের ওপর জোর বেশি দেওয়া হয়েছে। বেছে নেওয়া হয়েছে সহজ পথ। 

দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) সাবেক সভাপতি এম হুমায়ুন কবির মনে করেন, বৈশ্বিক ও দেশীয় পরিস্থিতির কারণে ব্যবসা খাত যে সমস্যায় রয়েছে, তা কাটাতে সহায়তা করার জন্য বাজেটে পদক্ষেপ নেই। এটা চোখ বুজে থাকার মতো। তিনি বলেন, এখন অগ্রিম আয়কর, অগ্রিম কর, ন্যূনতম করে কিছুটা ছাড় দেওয়া হলে উৎপাদন ব্যয় কমত। চাহিদা বাড়ত, বিক্রি বাড়ত। তখন ভ্যাটের মাধ্যমে সরকার বাড়তি রাজস্ব আদায় করতে পারত।