ব্যক্তি খাতে বাড়িভাড়া-চিকিৎসা ভাতা ও সরকারি কর্মীদের ভাতায় কর অব্যাহতি বাতিলের সুপারিশ

ব্যক্তি খাতের করদাতারা এখন বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতায় (যা মোট বেতনের এক-তৃতীয়াংশ) কর অব্যাহতি পান। এই সুবিধা বাতিল করার পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এ ছাড়া সরকারি কর্মচারীদের দেওয়া বিভিন্ন ধরনের ভাতার বিপরীতেও কর অব্যাহতির সুযোগ না দেওয়ার কথা বলেছে সংস্থাটি।

আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে করছাড় কমানোর ব্যাপারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। সংস্থাটি রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় ও বিভিন্ন ধরনের বন্ডে সরকারের দেওয়া করসুবিধা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া শেয়ারবাজার থেকে অর্জিত আয়ের ওপর দেওয়া করছাড়ও বাতিলের পক্ষে মত দিয়েছে তারা। শুধু তা–ই নয়, এনবিআরের মাধ্যমে করছাড় দেওয়ার যেসব বিধান রয়েছে, সেগুলো বাতিলের পাশাপাশি বিদ্যমান করছাড়ের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তা আর না বাড়ানোর সুপারিশ করেছে আইএমএফ। এ ছাড়া ব্যক্তি খাতে বিদ্যমান করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর পাশাপাশি ন্যূনতম করহার ৫ থেকে ১০ শতাংশে উন্নীত করার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।

গতকাল বৃহস্পতিবার এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুলসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠককালে ঢাকা সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদল এসব সুপারিশ–পরামর্শ জানিয়েছে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে আইএমএফ প্রতিনিধিদলে ছিলেন ডেভিড বার, আরবিন্দ মোদি ও ডেভিড ওয়েন্টওয়ার্থ নামের তিন কর্মকর্তা। করছাড় বিষয়ে প্রায় দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ শেষে প্রতিনিধিদলটি তাদের পর্যবেক্ষণের আলোকে পরামর্শগুলো দেয়।

এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ করছাড়ের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠান তথা করপোরেট পর্যায়ে ৮৫ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা ও ব্যক্তিপর্যায়ের করদাতাদের ৪০ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা ছাড় দেওয়া হয়। আর চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে করছাড়ের মোট পরিমাণ প্রাক্কলন করা হয়েছে ১ লাখ ৭৮ হাজার ২৪১ কোটি টাকা।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, এনবিআরকে ব্যক্তি খাতের আয়কর কাঠামো পুনর্গঠনের পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। তারা ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা করার কথা বলেছে। তবে বার্ষিক ৫ লাখ থেকে ৮ লাখ টাকা আয়ের ক্ষেত্রে কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার পরামর্শ দিয়েছে।

বৈঠকে আইএমএফ রেমিট্যান্স তথা প্রবাসী আয়ের ওপর করসুবিধা প্রত্যাহারের পরামর্শ দিয়েছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে প্রবাসী আয়। ব্যাংকের মাধ্যমে প্রবাসী আয় পাঠানোয় উৎসাহ দিতে সরকার এই খাতে কর আরোপ করে না। উল্টো গত কয়েক বছর ধরে প্রবাসী আয়ের বিপরীতে সরকার প্রণোদনা দিয়ে আসছে। বর্তমানে সেই প্রণোদনা বেড়ে হয়েছে আড়াই শতাংশ।

রাজস্ব আদায় বাড়াতে আইএমএফের প্রতিনিধিদলটি আগামী ২০২৪–২৫ অর্থবছর থেকে কোম্পানির রিটার্ন অনলাইনে জমা দেওয়ার বিধান চালু করার পরামর্শ দিয়েছে। তারা বলেছে, চলতি ২০২৪ সালের জুনের পরে বড় কোম্পানিগুলোর জন্য অনলাইনে রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক করা দরকার। এর বাইরে যেসব প্রতিষ্ঠান কোনো ধরনের প্রণোদনা পায়, তাদের ক্ষেত্রেও অনলাইনে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা উচিত। তা না মানলে তাদের প্রণোদনা যেন বন্ধ করা হয়।

এদিকে অনলাইনে রিটার্ন জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদানের আশ্বাসও দিয়েছে আইএমএফ। একই সঙ্গে তারা করপোরেট আয়করের জন্য অবচয় ভাতার হার ও ভাতা মূল্যায়নের পরামর্শ দিয়েছে। তাদের মতে, ব্যবসায়ের লোকসান ১০ বছর পর্যন্ত চলতে দেওয়া যেতে পারে।

দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় বাড়লেও কর-জিডিপির অনুপাত এখন প্রায় বিশ্বের সর্বনিম্ন। এ ক্ষেত্রে সরকারকে আইএমএফ এমন পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে, যাতে চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছরের জুনের মধ্যে জিডিপির দশমিক ৫০ শতাংশ পরিমাণ অতিরিক্ত কর আদায় বাড়ে।

২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ। সংস্থাটি ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে ধাপে ধাপে ৩৮টি শর্ত পূরণের অঙ্গীকারের বিনিময়ে। সংস্থাটির কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার মূল শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যাংকঋণের সুদের হারের সীমা প্রত্যাহার, ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া, নির্দিষ্ট মাত্রায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রাখা, জ্বালানি তেলের দাম সব সময় আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিলিয়ে সমন্বয় করা, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় রাজস্ব সংগ্রহের হার বৃদ্ধি, সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে সরকারের ঋণ সংগ্রহ কমিয়ে আনা ইত্যাদি।