পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনায় সৌদি কোম্পানি, ২২ বছরের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর

পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনা করবে সৌদি কোম্পানি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চুক্তি সইয়ের পর সৌদি মন্ত্রী খালিদ আল–ফালিহ এবং সালমান এফ রহমান আজ দুপুরে চট্টগ্রামে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিদর্শন করেনছবি: বিজ্ঞপ্তি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) এবং সৌদি আরবের কোম্পানি রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল (আরএসজিটি) এর মধ্যে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) পরিচালনার ক্ষেত্রে ‘কনসেশন চুক্তি’ বাংলাদেশে সৌদি বিনিয়োগ বাড়াতে আরও সহায়ক হবে। তিনি বলেন, ‘এই “কনসেশন চুক্তি” আমাদের দুই দেশের যৌথ স্বপ্নের এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও সমৃদ্ধির প্রতি অবিচল অঙ্গীকারের প্রমাণ।’

আজ বুধবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তিনিসহ সৌদি বিনিয়োগমন্ত্রী খালিদ আল ফালিহের উপস্থিতিতে সিপিএ চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল এবং ‘আরএসজিটি’র সিইও জিন্স ও ফোলি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।

এর আগে সৌদি মন্ত্রী সকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।

চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘যেহেতু আমরা এই “কনসেশন চুক্তি স্বাক্ষর” প্রত্যক্ষ করছি, তাই আমরা এমন একটি ভবিষ্যতের অপেক্ষায় আছি, যেখানে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আরএসজিটি আগামী ২২ বছর পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনা করবে। এটি বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করবে। তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্প বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য একটি আশার আলো।

সরকারপ্রধান বলেন, স্বনির্ভর এই আধুনিক টার্মিনাল বন্দরের সক্ষমতা বাড়াবে, নিরবচ্ছিন্ন বাণিজ্য সহজ করবে এবং কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা সৃষ্টি করবে। শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘এটি বিশ্ববাণিজ্যের একটি প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করবে। আমাদের ব্যবসার জন্য বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, টার্মিনালটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সাহায্য করবে। কারণ, ভারত, ভুটান ও নেপাল এই টার্মিনাল ব্যবহার করতে পারবে।

শেখ হাসিনা বলেন, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে সৌদি আরবের বিনিয়োগ বৈশ্বিক মঞ্চে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে।

প্রধানমন্ত্রী সৌদি আরবকে বন্ধুপ্রতিম দেশ এবং বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘সৌদি আরবের জনগণের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের গভীর শ্রদ্ধা ও আস্থা রয়েছে। আমরা সব সময়ই সৌদি আরবকে আমাদের হৃদয়ের কাছাকাছি পেয়েছি।’

শেখ হাসিনা বলেন, আরএসজিটি সৌদি সরকার কর্তৃক মনোনীত একটি স্বনামধন্য গ্লোবাল টার্মিনাল অপারেটর।

প্রধানমন্ত্রী পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার জন্য টার্মিনাল অপারেটর নিয়োগের কারণে সৌদি সরকারকে তাঁর আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সৌদি কর্তৃপক্ষের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের চলমান উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনার স্বীকৃতি। তিনি আরও বলেন, ‘আমি আশা করি, জেদ্দা বন্দর এবং অন্যান্য টার্মিনাল পরিচালনার জন্য খ্যাতি অর্জনকারী আরএসজিটি পতেঙ্গা  কনটেইনার টার্মিনালও তার দক্ষতা এবং প্রযুক্তিগত জ্ঞানের সঙ্গে পরিচালনা করবে।’

সরকারপ্রধান উল্লেখ করেন, এতে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম আরও দক্ষ এবং আন্তর্জাতিক মানের হবে। তিনি বলেন, ‘এর ফলে আমদানি-রপ্তানি ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়ে আমাদের অর্থনীতি উপকৃত হবে।’

প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের প্রতি আস্থা ও সহযোগিতার জন্য বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ এবং যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে দৃঢ় সমর্থনের জন্য তিনি সৌদি বিনিয়োগমন্ত্রী ও তাঁর প্রতিনিধিদলকে ধন্যবাদ জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আপনার প্রতিশ্রুতি গভীরভাবে প্রশংসিত।

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাত ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান, সৌদি বিনিয়োগমন্ত্রী খালিদ আল ফালিহ এবং আরএসজিটি চেয়ারম্যান আমের এ. আলীরেজা বক্তব্য দেন। উদ্বোধনী বক্তব্য দেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। এ সময় বাংলাদেশে সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত এসা বিন ইউসুফ আল দুহাইলান ছাড়াও সৌদি ও বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন।

আরেক সংবাদে বাসস জানায়, ‘আরএসজিটি’ একটি আন্তর্জাতিক টার্মিনাল অপারেটর, যা মালয়েশিয়ান মাইনিং কোম্পানির সঙ্গে অংশীদারত্বের প্রতিনিধিত্ব করে।

সম্মিলিত সম্পদ, পরিচালনার ক্ষমতা এবং অভিজ্ঞতা আরএসজিটিকে বিশ্বব্যাপী ১০টি বৃহত্তম কনটেইনার টার্মিনাল অপারেটরগুলোর মধ্যে একটিতে পরিণত করেছে। যার সম্মিলিত বার্ষিক কনটেইনার হ্যান্ডলিং ক্ষমতা ২০ মিলিয়ন এবং থ্রুপুট–পদ্ধতিতে টার্মিনালটির ১০ মিলিয়ন  কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা রয়েছে।

চার খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ 

সৌদি আরবের বিনিয়োগমন্ত্রী খালিদ এ আল-ফালিহের নেতৃত্বে দেশটির ৪০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফরে রয়েছে। দলটি গত মঙ্গলবার ঢাকায় পৌঁছানোর পর আজ সকাল ও বিকেলে পৃথক অনুষ্ঠানে দেশের সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে।

গত বুধবার সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে সৌদি–বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিলের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দেশে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই বৈঠকের আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সৌদি মন্ত্রী খালিদ এ আল ফালিহ। উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সৌদি আরবের বিনিয়োগবিষয়ক উপমন্ত্রী বদর আই আলবদর ও এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম প্রমুখ।

বৈঠকে সৌদি আরবের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের চারটি খাতে বাণিজ্য–বিনিয়োগ বৃদ্ধির বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন। খাত চারটি হচ্ছে খাদ্যনিরাপত্তা, জ্বালানি, সরবরাহ ও উৎপাদন। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানিয়েছে এফবিসিসিআই।

অনুষ্ঠানে সৌদি আরবের মন্ত্রী খালিদ এ আল ফালিহ বলেন, এত দিন সৌদি আরব ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক শুধু কয়েকটি খাতে বিদ্যমান ছিল। তবে আমরা কীভাবে উভয় দেশের জন্য পারস্পরিক সুবিধার জন্য বাণিজ্যকে সহজতর করতে পারি, তার উপায়গুলো খুঁজে বের করার সময় এসেছে। 

সালমান এফ রহমান বলেন, সৌদি আরব ও বাংলাদেশের মধ্যে ব্যাপক বাণিজ্য সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগাতে বাংলাদেশ সরকার উভয় দেশের ব্যবসায়ীদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।

অনুষ্ঠান শেষে এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে সৌদি আরবের অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমরা দেশটির ব্যবসায়ীদের এসব খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছি। বিশেষ করে সরকার সৌদি আরবের বিনিয়োগকারীদের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে ৩০০ একর জমি বরাদ্দ রেখেছে। বরাদ্দকৃত জমিতে শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য সৌদি ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি।’

 বুধবার বিকেলে একই হোটেলে সৌদি আরবের সফররত ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশীজনের একটি বিজনেস কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) আয়োজনে ওই কর্মশালায় দেশের সরকারি–বেসরকারি খাতের বিভিন্ন প্রতিনিধি অংশ নেন।

চট্টগ্রামে সৌদি মন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চুক্তি সইয়ের পর সৌদি মন্ত্রী খালিদ আল–ফালিহ এবং সালমান এফ রহমান আজ দুপুরে চট্টগ্রামে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিদর্শন করেন। টার্মিনাল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তাঁরা।

সৌদি মন্ত্রী বলেন, এটা চমৎকার স্থাপনা। আমরা খুবই আনন্দিত যে রেড সি গেটওয়ের সঙ্গে ২২ বছরব্যাপী এই টার্মিনাল পরিচালনার চুক্তি হয়েছে। এটা শুধু কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনা নয়, এটা মূলত বাংলাদেশে আমাদের (সৌদি আরবের) অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর কেন্দ্র হতে যাচ্ছে।

খালিদ এ আল-ফালিহ বলেন, এ অঞ্চলে লজিস্টিকস ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হতে চলেছে বাংলাদেশ। এ জন্য সৌদি আরবের বড় ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল এসেছে। তারা বিনিয়োগ সম্ভাবনাময় খাতগুলো দেখছে। বাংলাদেশের বিনিয়োগের সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল অভিহিত করে তিনি বলেন, সৌদি আরব জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ করতে চায়। এখানে বিদ্যুৎ, কৃষি ও প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের সুযোগ আছে।

প্রধানমন্ত্রীর বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, ‘এটা মাত্র শুরু। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌদি আরবের বাদশাহ ও যুবরাজের খুব ভালো সম্পর্ক আছে। তাঁরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চান। খুব শিগগির আরও অনেক বড় বড় বিনিয়োগ আসবে।’

পরিদর্শনের সময় নৌপরিবহনসচিব মোস্তফা কামাল, চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।