নজর এখন রোলস রয়েস, বেন্টলি, রেঞ্জ রোভারে

শুল্কসুবিধায় বিলাসবহুল গাড়ির হাইব্রিড ও বৈদ্যুতিক সংস্করণের আমদানি বাড়ছে।

রোলস রয়েস, বেন্টলি ও রেঞ্জ রোভার

ঢাকার রাস্তায় কয়েক বছর ধরে মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ ও অডি গাড়ি চলাচলের দৃশ্য পরিচিত হয়ে গেছে। রাজধানীর অলিগলিতেও এখন চোখে পড়ে এসব গাড়ি। কারণ, গত ছয় বছরে বিলাসবহুল এসব গাড়ি আমদানি দুই হাজার ছাড়িয়েছে। তবে এখন এই তালিকায় ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে রেঞ্জ রোভার, রোলস রয়েস, পোরশে, বেন্টলির মতো আরও বিলাসবহুল গাড়ি। অর্থনৈতিক সংকটেও এসব গাড়ির আমদানি হচ্ছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যে দেখা যায়, বাজেট সামনে রেখে এবার গাড়ি আমদানি সার্বিকভাবে কিছুটা কম। যেমন চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ২৮ মে পর্যন্ত ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ি আমদানি হয়েছে ১৬ হাজার ৭৪২টি। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ১৮ হাজার ৩৪৯টি। মূলত নতুন গাড়ি আমদানি কমে যাওয়ায় মোট আমদানিতে প্রভাব পড়েছে। পুরোনো গাড়ি আমদানি খুব একটা কমেনি।

গাড়ি আমদানিতে কিছুটা মন্দা থাকলেও চার ধরনের বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি বেড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রেঞ্জ রোভার, বেন্টলি, পোরশে ও রোলস রয়েসের মতো দামি গাড়ি। চলতি অর্থবছরের ২৮ মে পর্যন্ত রেঞ্জ রোভার, রোলস রয়েস, বেন্টলি ও পোরশে—এই চার ধরনের গাড়ি আমদানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে। এই চার ব্র্যান্ডের গাড়ি এবার এসেছে ৩১টি। গত অর্থবছর একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৮টি।

গাড়ি ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিলাসবহুল যেসব গাড়ি আসছে, সেগুলো হয় হাইব্রিড নয়তো সম্পূর্ণ বৈদ্যুতিক গাড়ি। এই দুই ধরনের গাড়িতে শুল্ক–করের হার কম। যেমন চার হাজারের বেশি সিলিন্ডার ক্ষমতার (সিসি) গাড়িতে যেখানে সোয়া আট গুণ শুল্ক–কর দিতে হয়, সেখানে বৈদ্যুতিক গাড়িতে এই হার এক গুণের কম, ৮৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। হাইব্রিড গাড়িতে করভার তেলচালিত গাড়ির তুলনায় কম। মূলত এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে বিলাসবহুল ব্র্যান্ডের গাড়ি আমদানি বেড়েছে।

গাড়ির বাজারে নতুন এই প্রবণতা নিয়ে জানতে চাইলে জার্মানির অডি গাড়ির পরিবেশক প্রোগ্রেস মোটরস ইম্পোর্টসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, জীবাশ্ম চালিত বিলাসবহুল গাড়ির করভার বেশি থাকায় বছর পাঁচেক আগেও আমদানি খুব বেশি ছিল না। তবে ইউরোপিয়ান কোম্পানিগুলো হাইব্রিড ও বৈদ্যুতিক গাড়ি বাজারজাতের পর দেশে কয়েক বছর ধরে এ ধরনের গাড়ি আমদানি বাড়ছে। জীবাশ্ম চালিত গাড়ির তুলনায় শুল্কসুবিধা থাকায় এ ধরনের গাড়ি আমদানির পথ খুলেছে।

রোলস রয়েসের সংখ্যা এখন ৫

বাংলাদেশে রোলস রয়েস গাড়ি আমদানির কথা প্রথম জানা যায় ২০১৭ সালে। উত্তর কোরিয়ার এক কূটনীতিক মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে এই গাড়ি আমদানি করেছিলেন। শুল্ক গোয়েন্দার জালে ধরা পড়ার পর বেরিয়ে আসে, গাড়িটির বাজারমূল্য ৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অবশ্য শুল্ক–করই ছিল ২২ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের রুপালি রঙের ৬ হাজার ৬০০ সিসির এই গাড়ি ঢাকার কমলাপুর আইসিডি থেকে জব্দ করা হয়েছিল।

২০২২ সালে চট্টগ্রামের ইপিজেডের একটি প্রতিষ্ঠান শুল্কমুক্ত সুবিধায় আরেকটি রোলস রয়েস গাড়ি আমদানি করেছিল। তবে শুল্কায়নের আগে গাড়িটি ঢাকায় সরিয়ে নেওয়ায় তা জব্দ করেছিল শুল্ক গোয়েন্দা। পরে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এক বিচারাদেশে গাড়িটি খালাসে ২৮ কোটি ২৯ লাখ টাকা শুল্ক–কর পরিশোধের নির্দেশ দেয়। জরিমানা করা হয় ৫৮ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গাড়ি খালাসে শুল্ক–কর, জরিমানাসহ ৮৫ কোটি টাকা দেওয়ার আদেশ দেয় কাস্টমস। এই দুটি গাড়ি ছাড়া বৈধভাবে গত ছয় বছরে তিনটি রোলস রয়েস গাড়ি আমদানি হয়েছে।

রোলস রয়েস ব্র্যান্ডের সর্বশেষ গাড়িটি আমদানি হয়েছে গত এপ্রিলে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে গত ২৮ এপ্রিল খালাস নেওয়া এই গাড়ি আমদানি করেছে ঢাকার প্রিয়াঙ্কা ট্রেডিং লিমিটেড। এই বৈদ্যুতিক গাড়ির আমদানিমূল্য ছিল ২ লাখ ৭০ হাজার পাউন্ড। চট্টগ্রাম কাস্টমস গাড়িটির শুল্কায়ন মূল্য ৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা ধরে শুল্কায়ন করেছে। বৈদ্যুতিক গাড়ি হওয়ায় শুল্ক–করের হার ছিল ৮৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। তাতে শুল্ক–কর দিতে হয়েছে ৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এ হিসাবে রোলস রয়েস ব্র্যান্ডের গাড়িটি আমদানিতে সব মিলিয়ে খরচ পড়েছে ৭ কোটি ৮২ লাখ টাকা। তবে বৈদ্যুতিক গাড়ি না হলে এই গাড়ির (চার হাজার সিসির বেশি ধরে) শুল্ক–কর দিতে হতো ৮২৬ দশমিক ৬০ শতাংশ বা ৩৪ কোটি টাকা।

আসছে বেন্টলি, রেঞ্জ রোভার

বাংলাদেশে আমদানি হওয়া দামি গাড়ির তালিকায় রোলস রয়েসের পরেই রয়েছে বেন্টলি ও রেঞ্জ রোভার ব্র্যান্ড। বেন্টলি গাড়ি আমদানিতে শুল্ক–করসহ খরচ পড়েছে ৬ কোটি থেকে পৌনে ৭ কোটি টাকা। রেঞ্জ রোভার গাড়ি আমদানিতে ৫ কোটি টাকার বেশি খরচ পড়ছে। পোরশে ব্র্যান্ডের বৈদ্যুতিক গাড়িতে খরচ পড়ছে ২ কোটি ৬১ লাখ টাকা।

এনবিআরের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে রেঞ্জ রোভার গাড়ি আমদানি হয়েছে ২০টি। এ ছাড়া বেন্টলি গাড়ি নয়টি এবং পোরশে গাড়ি আমদানি হয়েছে একটি। এই চার ব্র্যান্ডের গাড়ি আমদানি বাড়লেও কমেছে মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ ও অডি ব্র্যান্ডের গাড়ি আমদানি। গত অর্থবছরের জুলাই থেকে ২৮ মে পর্যন্ত এই তিন ব্র্যান্ডের গাড়ি আমদানি হয়েছিল ৩০৮টি। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছে ২২৬টি। অবশ্য এই তিন ব্র্যান্ডের বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানির হার বাড়ছে।

রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে শুল্ক–করসহ ৪ কোটি টাকার বেশি দাম পড়েছে এমন গাড়ি আমদানি হয়েছে ৫১টি। গত অর্থবছরে এই সময়ে আমদানি হয়েছিল ১৭টি।

এদিকে কয়েক বছর ধরে নতুন-পুরোনো মিলিয়ে হাইব্রিড ও বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানি বাড়ছে। চলতি অর্থবছরে এই দুই ধরনের গাড়ি আমদানি হয়েছে ৯ হাজার ১০৩টি, যা মোট গাড়ি আমদানির ৫৪ শতাংশ। গত অর্থবছরে এই হার ছিল ৪৮ শতাংশ। তার বিপরীতে তেলচালিত গাড়ি আমদানির গতি কিছুটা কম।

পুরোনো গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারভিডার মহাসচিব মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তেলচালিত গাড়ির পরিবর্তে এত দিন হাইব্রিড গাড়ির ব্যবহারের হার দ্রুত বেড়েছে। এখন এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে বৈদ্যুতিক গাড়ি।