বাড়তি শুল্ক–কর আদায়ই এখন বড় দুশ্চিন্তা

অর্থ মন্ত্রণালয়, এনবিআর ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কর্মকর্তাদের সঙ্গে গতকাল বৈঠক করেছে আইএমএফ।

চলতি অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বাড়তি রাজস্ব আদায় নিয়েই বেশি চিন্তিত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এনবিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে তাদের শর্ত অনুযায়ী কীভাবে বাড়তি শুল্ক-কর আদায় হবে, সেই পরিকল্পনা জানতে চেয়েছেন সংস্থাটির সফররত কর্মকর্তারা।

স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি চলতি অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৫ শতাংশ বাড়তি শুল্ক-কর আদায়ের শর্ত দেওয়া হয়েছে। এনবিআর শুল্ক, কর এবং ভ্যাট বিভাগ আলাদা আলাদাভাবে বাড়তি শুল্ক-কর আদায়ে পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। এনবিআরের বিভিন্ন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

গতকাল সোমবার এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে বৈঠক করেছেন আইএমএফের এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান রাহুল আনন্দ। সঙ্গে আইএমএফের প্রতিনিধিদলের অন্য সদস্যরাও ছিলেন। বৈঠকের বিষয়বস্তু ছিল—শর্ত অনুযায়ী বাড়তি রাজস্ব আদায়, কর অব্যাহতি, সংস্কারের পরিকল্পনা ইত্যাদি।

সভা শেষে এনবিআর চেয়ারম্যান গণমাধ্যমের কাছে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে এনবিআরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বৈঠকের যাবতীয় আলোচনার বিষয়বস্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে পুরো বিষয় গণমাধ্যমকে জানাবে। অন্যদিকে সভা শেষে রাহুল আনন্দকে বৈঠকের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনিও কিছু বলেননি।

এদিকে আইএমএফের সঙ্গে বৈঠকের আগে গতকাল এনবিআর চেয়ারম্যান শুল্ক, আয়কর এবং ভ্যাট নীতি শাখার তিন সদস্যের সঙ্গে সভা করেন। ওই বৈঠকে বাড়তি শুল্ক-কর আদায় কীভাবে হবে, সে বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যানকে জানানো হয় বলে জানা গেছে। আইএমএফকে রাজস্ব আদায় ও সংস্কারের বিষয়ে পরিকল্পনা জানানোর জন্য সংস্থাটির শুল্ক, আয়কর এবং ভ্যাট বিভাগ তিনটি আলাদা অবস্থানপত্র তৈরি করেছে।

যা আছে পরিকল্পনায়

আয়কর বিভাগের অবস্থানপত্রে বাড়তি শুল্ক আদায়ের কৌশল সম্পর্কে বলা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে আয়কর বিভাগকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আদায় করতে হবে, যা আগের বছরের চেয়ে সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকা বেশি। আয়কর বিভাগ মনে করছে, চলতি অর্থবছরে আয়করে ১৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। এতে প্রায় ১৫ হাজার ৪০০ কোটি অতিরিক্ত টাকা আসবে।

এ ছাড়া বাজেটে করহার বাড়ানোসহ অন্যান্য কারণে বেশ কয়েকটি খাত থেকে বাড়তি ৯ হাজার ১০০ কোটি টাকা আসবে। এগুলো হলো জমি নিবন্ধনে ৩ হাজার কোটি টাকা, ভ্রমণ কর ৫০০ কোটি টাকা, তামাকের ওপর কর ৩০০ কোটি টাকা, পরিবেশ সারচার্জ ও ন্যূনতম কর দেড় হাজার কোটি টাকা, করজাল সম্প্রসারণে (রিটার্ন দাখিলের সনদ দেখানোর বাধ্যবাধকতার খাত আরও ৫টি বাড়ানোর ফলে) আড়াই হাজার কোটি টাকা এবং কার্বোনেটেড বেভারেজের ওপর কর বৃদ্ধিতে ১ হাজার কোটি টাকা।এ ছাড়া বিভিন্ন খাতের বকেয়া থেকেও প্রায় ৩ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা বাড়তি আদায় করতে চায় এনবিআর।

অন্যদিকে আয়কর বিভাগের কাঠামোগত সংস্কার করতে চারটি বিশেষ ইউনিট স্থাপনের পরিকল্পনাও রয়েছে। এগুলো হলো কর গোয়েন্দার ইউনিট, উৎসে কর ব্যবস্থাপনা ইউনিট, ই-ট্যাক্স ব্যবস্থাপনা ইউনিট ও ইন্টারন্যাশনাল ট্যাক্স ইউনিট।

ভ্যাট বিভাগের অবস্থানপত্রে দেখা গেছে, আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী বাড়তি ভ্যাট আদায়ে বাজেটে নয়টি খাতে ভ্যাট অব্যাহতি তুলে দেওয়া বা ভ্যাট বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। যেসব খাতে ভ্যাট অব্যাহতি তুলে দিয়ে নতুন ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে, সেগুলো হলো মুঠোফোন, পলিপ্রোফাইলিন স্ট্যাপল ফাইবার, বলপয়েন্ট কলম, সফটওয়্যার ও এলপিজি সিলিন্ডার। ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে সিগারেট, জর্দা, গুল; প্লাস্টিক পণ্য, অ্যালুমিনিয়াম পণ্য ও সানগ্লাস। এসব খাত থেকে বাড়তি ভ্যাট আসবে বলে মনে করছে এনবিআর।

অন্যদিকে শুল্ক খাতে বাড়তি ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার মতো আদায় করতে হবে। শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে ফল আমদানিতে ২৩৬ কোটি টাকা বাড়তি আদায় হয়েছে। এভাবে আরও কিছু খাত থেকে বাড়তি শুল্ক আসবে। এ ছাড়া পেট্রোবাংলা থেকে বকেয়া কর আদায়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে।

২০২২-২৩ অর্থবছরে এনবিআরকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছিল। পরে আইএমএফ ৩ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা আদায়ের কথা বলে। কিন্তু বছর শেষে দেখা গেছে, এনবিআর আদায় করতে পেরেছে ৩ লাখ ৩১ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। এ নিয়ে গত বৃহস্পতিবার এনবিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে আইএমএফ অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।

জ্বালানি ও সারের ভর্তুকির বিষয়ে আইএমএফ

গতকাল আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভর্তুকি নিয়ে বৈঠক করেন। এ সময় আইএমএফ কর্মকর্তারা জ্বালানি তেল ও সারে ভর্তুকি কমানোর পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চান। জবাবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সারে আপাতত ভর্তুকি কমানোর কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে পর্যায়ক্রমে জ্বালানি তেলে ভর্তুকি কমিয়ে আনা হবে।