চার সংকটের মধ্যে শিল্প খাত

গ্যাসের চাপ কম। বিদ্যুতে লোডশেডিং। এতে কমছে উৎপাদন। ডলার নিয়ে অস্থিরতায় ঋণপত্র খুলতে অনিশ্চয়তা।

শিল্প খাতে উৎপাদন সচল রাখতে নিয়মিত কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। ঋণপত্রের ধরনভেদে এই কাঁচামাল আমদানির দুই থেকে ছয় মাস পর তা ব্যাংকে শোধ করেন ব্যবসায়ীরা। এখন যেসব চালানের ঋণ শোধ করছেন ব্যবসায়ীরা, তা ডলারপ্রতি দর ৮৬ টাকা থাকার সময় ঋণপত্র খোলা হয়। মে মাসে ৯৪-৯৫ টাকা দরে ডলার কিনে শোধ করেছেন তাঁরা। এ মাসে ১০৯ টাকা দরেও ডলার কিনে ঋণ শোধ করতে হয়েছে। এতে বিপুল অঙ্কের টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে তাঁদের।

জুলাই মাসের শেষে শিল্প খাতের সামনে এসে দাঁড়ায় আরেক সংকট—বিদ্যুতের লোডশেডিং। বিদ্যুৎ নিয়ে ভাবনা শেষ না হতেই সংকটের তালিকায় যুক্ত হয় গ্যাসের সমস্যা। অর্থাৎ গ্যাসের চাপ কম। এই দুই সংকটে শিল্প খাতে কারখানাভেদে উৎপাদন ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে ডলারের অস্থিরতায় ঋণপত্র খোলায় অনিশ্চয়তা। এতে কাঁচামাল আমদানি কমে গেছে।

রপ্তানি খাতের মতোই আমদানি প্রতিস্থাপক শিল্পকারখানাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এক ডলার বাঁচানো এক ডলার আয় করার সমান। বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিল্পকারখানায় গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহে অগ্রাধিকার ও ঋণপত্র খুলতে সহায়তা দেওয়া দরকার।
মোস্তাফিজুর রহমান, বিশেষ ফেলো, সিপিডি

এই চার সংকটে ভারী শিল্প ইস্পাত, সিমেন্ট, সিরামিকস, কাচ, রপ্তানিমুখী শিল্পসহ প্রায় সব কারখানার উৎপাদন কমেছে। আবার সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয়ের খাত তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে আগামী শরৎ ও গ্রীষ্ম মৌসুমের ক্রয়াদেশ কম আসছে। পোশাকের চলমান ক্রয়াদেশের পণ্য পাঠাতেও বিলম্ব করতে বলছে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান। দেশের শিল্প খাতে একই সময়ে এমন সংকট আগে খুব একটা দেখা যায়নি।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিল্পকারখানার উৎপাদন কমেছে। বিশ্বব্যাপী জ্বালানির খরচ বেড়ে গেছে। বেশি উৎপাদন করলে বেশি খরচ। সে জন্য আমরা শিল্পকারখানাকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিদ্যুৎ রেশনিং করতে সরকারকে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু সেভাবে হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, শিল্পকারখানায় লোডশেডিং হচ্ছে। বাসাবাড়িতে লোডশেডিং। আমাদের মনে হচ্ছে, এই জায়গাতে একটু সংশোধন লাগবে। অন্যদিকে গ্যাসনির্ভর শিল্পকারখানায় গ্যাসের চাপ কম। গ্যাস তো নিশ্চিত করা দরকার। লোডশেডিং হবে আবার গ্যাসের চাপও কম থাকবে, একসঙ্গে দুটো হওয়া তো উচিত নয়।’ গ্যাস ও বিদ্যুতের ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

খরচ বাড়ছে ইস্পাতে

চার সংকটের সব কটিই কমবেশি আছে ইস্পাত খাতে। শীর্ষস্থানীয় ইস্পাত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএমের কারখানায় গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে লোহার টুকরা থেকে বিলেট উৎপাদন কমেছে ৩০ শতাংশ। রড উৎপাদন কমেছে ১০ শতাংশ। গ্যাসের চাপ কম থাকায় বিকল্প হিসেবে ফার্নেস তেল ব্যবহার করছে প্রতিষ্ঠানটি। এতে উৎপাদন খরচ বাড়ছে বলে জানান বিএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত।

মোস্তফা হাকিম গ্রুপের রড উৎপাদনে স্বয়ংক্রিয় দুটি কারখানা রয়েছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও কর্ণফুলী উপজেলায়। কারখানা দুটির রড উৎপাদনক্ষমতা দিনে ১ হাজার ৬০০ টন। গত মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে বিদ্যুতের লোডশেডিং এবং পরে গ্যাসের চাপ কমতে থাকায় কারখানা দুটির উৎপাদন ৪০ শতাংশ কমেছে। দিনে এক পালায় উৎপাদন বন্ধ থাকছে কারখানা দুটির। তাতে নতুন করে উৎপাদন শুরু করতে দু-তিন ঘণ্টা সময় লাগছে। এ জন্য উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে।

মোস্তফা হাকিম গ্রুপের পরিচালক মো. সরওয়ার আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমদানি দায় শোধ করতে হিমশিম খাচ্ছি। এখন উৎপাদন কমাতে বাধ্য হয়েছি। আবার কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খুলতে আগের চেয়ে তিন-চার গুণ বেশি সময় লাগছে। বিদেশি ব্যাংকের অর্থায়নে বিলম্ব পরিশোধের সুবিধা নিয়ে ঋণপত্র খুলতেও সময় বেশি লাগছে।’

সিমেন্টে কাঁচামাল আমদানি কমেছে

সিমেন্ট উৎপাদনে প্রয়োজনীয় পাঁচটি কাঁচামালই আমদানিনির্ভর। চাহিদা কমে যাওয়ায় এই খাতের কাঁচামাল আমদানি কমতে শুরু করেছে। গত অর্থবছরে কাঁচামাল আমদানি কমার হার প্রায় ৮ শতাংশ। আমদানি কম হওয়ায় উৎপাদনও কম। বিদ্যুৎ-সংকটে উৎপাদন আরও কিছুটা কমেছে।

সিমেন্টশিল্পের উদ্যোক্তাদের বড় মাথাব্যথা অবশ্য ডলারের উচ্চ মূল্য। প্রতি মাসে আমদানি দায় পরিশোধে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তি খরচ হচ্ছে।

সিমেন্ট প্রস্তুতকারক সমিতির সভাপতি মো. আলমগীর কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘৩৫ বছর ধরে ব্যবসা করছি। ডলার নিয়ে এমন অনিশ্চয়তা কখনো দেখিনি।’ ডলার-সংকট না কাটলে সামনে এই খাতে আমদানি কমবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

চুল্লি সচল রাখার চ্যালেঞ্জ কাচশিল্পে

কাচশিল্পে চুল্লিতে ১ হাজার ৬০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কাঁচামাল গলিয়ে উৎপাদন করা হয়। এ জন্য এ শিল্পের অপরিহার্য উপাদান গ্যাস। কোনো কারণে গ্যাসের অভাবে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে চুল্লি ধ্বংস হয়ে যায়।

গত জুলাই থেকে গ্যাসের চাপ কম থাকায় কাচশিল্পের কারখানাগুলো এখন চুল্লি সচল রাখা নিয়ে লড়াই করছে। চট্টগ্রামের পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস, ঢাকায় নাসির ফ্লোট গ্লাসসহ চারটি কারখানায় বছরে পাঁচ লাখ টন কাচ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিও করছে তারা। তবে গ্যাস-সংকটে কাচ কারখানা উৎপাদন ধরে রাখতে পারছে না।

গ্যাসের চাপ কম থাকায় চট্টগ্রামের পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ কারখানাটির উৎপাদন ২৪০-২৫০ টন থেকে ১৭০-১৮০ টনে নেমে এসেছে। চুল্লি বাঁচানোর জন্য যেকোনোভাবেই হোক না কেন, উৎপাদন সচল রাখতে চায় কর্তৃপক্ষ।

জানতে চাইলে চট্টগ্রামের পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘উৎপাদন কমলেও আমরা হাল ছাড়িনি। সরকারের সহযোগিতায় এই শিল্প দাঁড়িয়েছে। শিগগিরই এ সংকট কাটবে বলে আশাবাদী।’

উৎপাদন কমেছে বস্ত্রকলে

গাজীপুরের মাওনায় আউটপিচ স্পিনিং মিলসে দিনে ৪৫ টন সুতা উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ জেনারেটরের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নিজস্ব ব্যবস্থা রয়েছে তাদের। পাশাপাশি বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে পল্লী বিদ্যুতের সংযোগও আছে। তবে লাইনে গ্যাসের চাপ কম থাকায় দিনে গড়ে সাড়ে ৪ টন থেকে পৌনে ৭ টন সুতা কম উৎপাদন হচ্ছে। তাদের সুতা উৎপাদনে খরচও বেড়ে যাচ্ছে।

আউটপিচ স্পিনিং মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাজীব হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাসের চাপ কম থাকায় দিনে ১০-১৫ শতাংশ সুতা উৎপাদন কম হচ্ছে। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত বেশি সমস্যা হচ্ছে।

মাওনার এই কারখানার মতো বস্ত্র খাতের অধিকাংশ কারখানা গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে কমবেশি ভুগছে। তাতে এলাকাভেদে বস্ত্রকলের উৎপাদন কমেছে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। উদ্যোক্তারা বলছেন, যখনই পণ্য উৎপাদন কম হবে, তখনই উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। অন্যদিকে ক্রয়াদেশও কম। ফলে পণ্যের মজুত বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে দুশ্চিন্তাও।

টাঙ্গাইলের সাদিয়া টেক্সটাইল মিলসের কারখানায় কাপড় উৎপাদন ও ডায়িং করা হয়। গ্যাসের চাপ কম থাকায় তাদের ডায়িং ইউনিটের উৎপাদন ২০ শতাংশের মতো কমেছে। হঠাৎ গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় কাপড় নষ্টও হচ্ছে। যদিও পল্লী বিদ্যুতের গ্রিডলাইনের সংযোগ থাকায় কাপড় উৎপাদন এখনো সেভাবে কমেনি। সাদিয়া টেক্সটাইলের এমডি আবদুল ওয়াদুদ চৌধুরী বলেন, সন্ধ্যা থেকে রাত দুইটা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ কম থাকছে।

জানতে চাইলে বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সহসভাপতি মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের বিল, শ্রমিকের মজুরি ও ব্যাংকের সুদ নিয়মিতই দিতে হয়। ফলে উৎপাদন কম হলেই খরচ বাড়ে; লোকসানের ঝুঁকি তৈরি হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে গড়ে ৩০ শতাংশ উৎপাদন কমে গেছে। তাতে উদ্যোক্তাদের লোকসানে পড়তে হবে।

সিরামিকও আছে সংকটে

সিরামিকশিল্পের অন্যতম উপাদান গ্যাস। সাম্প্রতিক গ্যাস-সংকটের কারণে সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছে না খাতটির অনেক কারখানা। কারখানাভেদে উৎপাদন ১০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। আবার ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় কাঁচামাল আমদানি খরচ বেড়েছে। শিগগিরই সিরামিক পণ্যের দাম বাড়ানোর জন্য হিসাব-নিকাশ করছে কোম্পানিগুলো। চলতি বছরই এক দফা দাম বাড়িয়েছিল তারা।

গ্রেটওয়াল সিরামিকের গাজীপুরের টাইলস কারখানার পাঁচটি চুল্লির মধ্যে দুটি বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে তারা। কারণ, ছয় ঘণ্টা গ্যাস থাকছে না। অন্যান্য সময়ও হঠাৎ হঠাৎ চাপ কমে যাওয়ায় চুল্লির সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে উৎপাদন কমেছে কমপক্ষে ১০ শতাংশ বলে জানান গ্রেটওয়াল সিরামিকের ব্যবস্থাপক আমিনুল ইসলাম।

জানতে চাইলে বিসিএমইএর সভাপতি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিটি কোম্পানিই লোকসান দিচ্ছে। কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা।’

বাংলাদেশ সিরামিক পণ্য উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিসিএমইএ) তথ্যানুযায়ী, সিরামিক খাতে বর্তমানে ৭০টি প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে তৈজসপত্রের ২০টি, টাইলসের ৩২টি ও স্যানিটারি পণ্য উৎপাদনের ১৮টি কারখানা। সিরামিক পণ্য উৎপাদনে মূল্য সংযোজন ৬৫ শতাংশ।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান গতকাল বুধবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, রপ্তানি খাতের মতোই আমদানি প্রতিস্থাপক শিল্পকারখানাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এক ডলার বাঁচানো এক ডলার আয় করার সমান। বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিল্পকারখানায় গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহে অগ্রাধিকার ও ঋণপত্র খুলতে সহায়তা দেওয়া দরকার। আমদানিকারকদের বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে। গত জুলাইয়ে আমদানি কমেছে। অন্যদিকে ডলার ও রপ্তানি আয় বেড়েছে। তাতে রিজার্ভের ওপর চাপ কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নিত্যপণ্য আমদানির জন্য প্রতিদিন ছয়-সাত কোটি ডলার বিক্রি করছে। পাশাপাশি শিল্পকারখানার কাঁচামাল আমদানির জন্যও ডলার বিক্রি করতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, বর্তমান সংকটে আমদানি-রপ্তানিতে মুদ্রা পাচার ঠেকাতে ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং বন্ধ করতে হবে। প্রবাসী আয় যাতে ব্যাংকিং চ্যানেলে আসে, সেটিও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ব্যাংক ও খোলাবাজারে এখনো ডলারের অনেক পার্থক্য রয়ে গেছে। ডলারের বিনিময় হারকে একটা স্বস্তির জায়গায় নিয়ে যাওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।