পথশিশুদের ৬২% কর্মক্ষেত্রে মার খায়, নির্যাতনের শিকার প্রায় সবাই

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) লোগোছবি: সংগৃহীত

দেশের প্রায় সব পথশিশু তাদের কর্মক্ষেত্রে কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হয়। এক জরিপে বলা হয়েছে, নির্যাতনের শিকার পথশিশুর হার প্রায় ৯৬ শতাংশ। তাদের মধ্যে প্রায় ৬১ দশমিক ৭ শতাংশ পথশিশু শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় বা মার খায়। প্রায় ৪৪ দশমিক ৮ শতাংশ শিশু মৌখিক হুমকি পায়। এ ছাড়া কাজ থেকে ছাঁটাই, মজুরি কমিয়ে দেওয়া—এসব ঘটনাও ঘটে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পথশিশুদের জরিপ ২০২২ প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। জরিপে আরও বলা হয়েছে, বেশির ভাগ পথশিশু সপ্তাহে ১ হাজার টাকা বা ১০ ডলারের কম অর্থের জন্য প্রতি সপ্তাহে ৩০ থেকে ৪০ ঘণ্টা কাজ করছে।

আজ সোমবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আগারগাঁওয়ের বিবিএস মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও দেশের আটটি বিভাগীয় শহরের ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৭ হাজার ২০০ পথশিশুর ওপর এই জরিপ চালানো হয়। গত বছরের এপ্রিলে মূল জরিপ হয়। তবে দেশে কত সংখ্যক পথশিশু আছে—তা জরিপে উঠে আসেনি। পথশিশুদের কাজের ক্ষেত্র, বাড়ি ছেড়ে আসার কারণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কোন এলাকা থেকে বেশি পথশিশু আসে—এসব চিত্র উঠে এসেছে। ইউনিসেফের সহায়তায় এ জরিপটি করেছে বিবিএস।

অনুষ্ঠানে জরিপের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন বিবিএসের ডেমোগ্রাফি অ্যান্ড হেলথ উইংয়ের পরিচালক মাসুদ আলম। জরিপের ফল অনুযায়ী, পথশিশুদের গড় বয়স ১২ দশমিক ৩ বছর। একজন মেয়ে পথশিশুর বিপরীতে চারজন ছেলে পথশিশু আছে। পথশিশুদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৯ শতাংশ এসেছে ময়মনসিংহ জেলা থেকে। আর দেশের মোট পথশিশুর মধ্যে ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি সাড়ে ৪৮ শতাংশ পথশিশু অবস্থান করছে। এর মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় ৪১ শতাংশ পথশিশুর বসবাস।

বাংলাদেশে শিশুশ্রম আইনিভাবে নিষিদ্ধ, এমন প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘এই পথশিশুদের কাজগুলো আনুষ্ঠানিক নয়। তাদের কাজগুলো আমাদের সংস্কৃতিতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। আমরা অদূর ভবিষ্যতে শিশুশ্রম নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব।’

বিবিএসের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, ‘এই পথশিশুদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় অনেক সময় ধরে বসিয়ে রেখেছেন। তাদের ১০ থেকে ২০ টাকা দিয়েছেন কি না, জানি না। তবে তাদের অবশ্য পারিশ্রামিক দেওয়া উচিত। বিভিন্ন প্রকল্পে আমরা সম্মানিতদের জন্য সম্মানীর টাকা বরাদ্দ রাখি। কিন্তু এই পথশিশুদের মতো জরিপে অংশ নেওয়াদের এক ঘণ্টা বসিয়ে রেখে প্রশ্ন করি, তাদের জন্য ১০০ টাকা বরাদ্দ রাখা যেতে পারে।’

প্রকল্পে এমন বরাদ্দ রাখার পক্ষে মত দেন তিনি। এ ছাড়া তিনি পথশিশুদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা বাড়ানোর তাগিদও দেন।

পথশিশুরা কী ধরনের কাজ করে
জরিপে অংশ নেওয়া পথশিশুদের একটা বড় অংশ বাড়ি ছাড়ে। বাড়ি ছাড়ার কারণ কী, এমন প্রশ্ন করা হলে ৩৭ দশমিক ৮ শতাংশ পথশিশু জানিয়েছে, দারিদ্র্য ও ক্ষুধার কারণে তাঁরা বাড়ি ছেড়েছে। ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু জানিয়েছে, মা-বাবা শহরে এসেছেন, তাই তারাও তাদের সঙ্গে এসেছে। ১২ দশমিক ১ শতাংশের উত্তর ছিল—কাজের সন্ধানে এসেছে।

জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, ২০ দশমিক ৯ শতাংশ পথশিশু বর্জ্য সংগ্রহের কাজ করে। ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ পথশিশু ভিক্ষাবৃত্তি ও ভিক্ষায় সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করে। পরিবহন খাতে আছে ১৬ শতাংশ পথশিশু। এ ছাড়া হোটেল, রেস্তোরাঁ, চায়ের দোকান, ধোয়ামোছা ও হকার হিসেবেও কাজ করে। কেউ কেউ ছোটখাটো অপরাধ ও যৌনকর্মের মতো কাজও করে থাকে।

জরিপে আরও উঠে এসেছে, ৬৪ শতাংশ পথশিশু পরিবারে আর ফিরে যেতে চায় না। প্রতি দশজন পথশিশুর চারজন কখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি। প্রায় চার ভাগের এক ভাগ পথশিশু ধূমপান করে। ১২ শতাংশ মাদকের নেশায় আসক্ত।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম, ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব শাহনাজ আরেফিন, বিবিএস মহাপরিচালক মতিয়ার রহমান প্রমুখ।