ঢাকার কেরানীগঞ্জের পানগাঁও নৌ টার্মিনাল পরিচালনায় ২২ বছরের জন্য দায়িত্ব পেয়েছে সুইজারল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান মেডলগ। টার্মিনালটি নির্মাণের এক যুগের বেশি সময় পরও এটিকে লাভজনক করতে না পারায় সেটিকে বিদেশিদের হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। তবে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত এই টার্মিনাল শুধু পরিচালনার দায়িত্ব কেন বিদেশিদের হাতে দেওয়া হলো—এ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যেও রয়েছে নানা আলোচনা।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে পানগাঁও টার্মিনালটি নির্মাণ করে। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত এই কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণে ব্যয় হয় ১৪৯ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে এটির কার্যক্রম শুরু হলেও প্রথম জাহাজ ভেড়ে ২০১৫ সালে। পরে ২০১৮ সাল থেকে কনটেইনার ওঠানামা বাড়তে থাকে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৮ হাজারের বেশি একক কনটেইনার পণ্য ব্যবস্থাপনা হয় এই টার্মিনালে। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা দেড় হাজার একক কনটেইনারে নেমে আসে।
সরকারি হিসাবে, গত ১২ বছরে প্রায় ১৬৫ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে এই টার্মিনালে। প্রতি মাসে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা লোকসান করে টার্মিনালটি। এখন বিদেশিদের হাতে দেওয়ায় বছরে ১ কোটি ১ লাখ টাকা মাশুল পাবে সরকার।
সরেজমিনে গতকাল পানগাঁও টার্মিনাল ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোনো কর্মচাঞ্চল্য ছিল না সেখানে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ব্যস্ত নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনায়। সবার মাঝে গতকাল আলোচনার মূল বিষয় ছিল এরপর কী হবে? টার্মিনালটির একাধিক কর্মকর্তা জানান, সর্বশেষ এই টার্মিনালে পণ্যবোঝাই জাহাজ ভিড়েছিল ১১ নভেম্বর। তাঁরা জানান, বর্তমানে সপ্তাহে একটিও জাহাজ আসে না। তাই জাহাজ না থাকলে এই টার্মিনালে নিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে শ্রমিকদের তেমন ব্যস্ততা থাকে না। তাই জাহাজ না থাকলে অনেকটা অলস সময় কাটে তাঁদের। গতকালও তেমনই দেখা যায় সরেজমিনে। তবে এই অলস সময়ের আলোচনায় যুক্ত হয়েছে বিদেশিদের সঙ্গে করা টার্মিনালটি পরিচালনা চুক্তি। এই চুক্তির কারণে কারা থাকবেন, কারা থাকবেন না—এই ছিল আলোচনার মূল বিষয়। অনেকেই বিদায়ের প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেছেন।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই টার্মিনালে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক মিলিয়ে বর্তমানে রয়েছেন ৫০০ জন। যার মধ্যে ৩৯১ জনই শ্রমিক। এর বাইরে আছেন কাস্টমসের কর্মকর্তা। এ ছাড়া পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজে বেসরকারি খাতের বেশ কিছু শ্রমিক ভাড়ায় কাজ করেন। তবে টার্মিনালে জাহাজ না ভিড়লে শ্রমিকদের নিয়মিত তেমন কোনো কাজ থাকে না। টার্মিনালটি পরিচালনায় বিদেশিদের সঙ্গে চুক্তির পর এসব শ্রমিক এখন আরও বেশি শঙ্কিত তাঁদের চাকরি নিয়ে। চাকরি বহালের দাবিতে গতকাল টার্মিনাল শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. জাকির হোসেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছেন। জানতে চাইলে জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাজ নেই, তাই আমাদের দিন কাটছে কষ্টে। এখন বিদেশিদের সঙ্গে চুক্তির পর চাকরি থাকবে কি না, সেটা নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে।’
পানগাঁও টার্মিনাল দিয়ে আমদানি হওয়া কৃষিপণ্যের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাইয়ের জন্য দায়িত্ব পালন করেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আফরিন সুলতানা। তিনিও এখন শঙ্কায় আছেন চুক্তির পর তাঁর অবস্থান কী হবে, সেই ভাবনায়। আফরিন সুলতানা জানান, এই টার্মিনাল দিয়ে কখনো মাসে একটি, কখনো বড়জোর দুটি কৃষিপণ্যের চালান আসে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই টার্মিনালের বিভিন্ন ধরনের কাজের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের প্রায় ১০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী নিযুক্ত রয়েছেন। তাঁদের সবাই ধারণা করছেন নতুন চুক্তির ফলে তাঁদের এই টার্মিনাল থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে। টার্মিনালটির দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন বন্দর নিযুক্ত একজন টার্মিনাল ব্যবস্থাপক। গতকাল কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাঁর কাছে নানা বিষয় জানতে ভিড় করেন। কিন্তু তিনিও সুনির্দিষ্ট করে কিছু জানাতে পারছেন না। পরে টার্মিনাল ব্যবস্থাপকের সঙ্গে টার্মিনালের নানা বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
টার্মিনালটির একাধিক কর্মকর্তা জানান, এখন টার্মিনালে ১৫৪টি পণ্যভর্তি কনটেইনার রয়েছে। তার মধ্যে ১০৮টিই বিভিন্ন মামলায় নিলামে উঠেছে। তাঁরা জানান, বর্তমানে মাসে গড়ে পণ্যবোঝাই তিনটি জাহাজ ভেড়ে এই টার্মিনালে। এই টার্মিনাল দিয়ে কম পণ্য আসার জন্য পণ্য খালাসে দীর্ঘসূত্রতা ও বেশি খরচকে বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট নেওয়াজ শরিফ। তিনি বলেন, বিগত সরকারের আমলে একটি স্থানীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠী টার্মিনালটি পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার চেষ্টা চালায়।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পানগাঁও টার্মিনালে এক কনটেইনার পণ্য পরিবহনে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা ভাড়া পড়ে। কিন্তু রেলপথে পণ্য পরিবহনে খরচ তার চেয়ে কম। আবার সময়ও লাগে বেশি। তাই এই টার্মিনাল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন ব্যবহারকারীরা।