কর্মসংস্থান: হালনাগাদ তথ্য নেই, তবে চাকরির বাজারে দারুন মন্দা

সরকারের কর্মসংস্থানের সাম্প্রতিক তথ্যও পাঁচ বছরের পুরোনো। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোভিড, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও ডলার–সংকটের কারণে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না, কর্মসংস্থানে টান পড়েছে।

যে কারণে কর্মসংস্থানে টান

  • পোশাক খাতে বিনিয়োগ নেই, নতুন কর্মী নিয়োগ হচ্ছে না।

  • বাস-ট্রাক নিবন্ধন কমেছে, হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়েছে।

  • কোম্পানি, ফার্ম, অংশীদারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন কমেছে।

  • ২০ শতাংশ কমেছে চাকরির বিজ্ঞাপন।

ছবি: সংগৃহীত

সরকারের হাতে কর্মসংস্থান হালনাগাদের কোনো তথ্য নেই। চাকরির সুযোগ বাড়ল নাকি কমল, এর প্রবণতা বুঝতে সরকারি কোনো পরিসংখ্যান নেই। আবার মানুষের আয় বেড়েছে কি না, এর কোনো হালনাগাদ পরিসংখ্যানও নেই। মানুষের কর্মসংস্থান, আয়-ব্যয়ের প্রকৃত চিত্র মিলছে না।

এসব তথ্য জানার জন্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ এবং খানা আয় ও ব্যয় জরিপের ফলাফল দরকার। কিন্তু পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে শ্রমশক্তি জরিপ এবং খানা আয় ও ব্যয় জরিপ—কোনোটিই হয়নি।

অথচ এই সময়ের মধ্যে কোভিড মহামারি হয়েছে। এ সময় হাজারো মানুষ কাজ হারিয়েছেন। এখনো সেই ক্ষতি পুষিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। আবার বৈশ্বিক অর্থনীতির সংকটের প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতে। ডলার–সংকটে খরচ বেড়ে যাওয়ায় নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী দেখাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। সার্বিকভাবে বিনিয়োগের গতিও বেশ মন্থর। বিনিয়োগ প্রস্তাব কম আসছে। নতুন কোম্পানি, ফার্ম, অংশীদারি প্রতিষ্ঠা

—এসবের নিবন্ধন আগের চেয়ে কমেছে।
এর সবকিছুই পরিষ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে যে দেশে চাকরির বাজার সীমিত হয়েছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ কমেছে।

কর্মসংস্থান পরিস্থিতি কি জানা যাচ্ছে

তৈরি পোশাক খাত হলো বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের অন্যতম উৎস। কিন্তু শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা মনে করেন, এই খাতের কর্মসংস্থানে এখন টান পড়েছে। কারখানাগুলোয় নতুন কর্মসংস্থান তো হচ্ছেই না, বরং কেউ কাজ ছেড়ে গেলে শূন্য পদ পূরণ করছেন না কারখানা মালিকেরা।

একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। নারায়ণগঞ্জের এমবি নিট ফ্যাশন লিমিটেড দেশের অন্যতম বড় নিট পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। কোভিড শুরুর পর থেকে এই কারখানায় কোনো সম্প্রসারণ হয়নি, নতুন বিনিয়োগও হয়নি। গত ছয় মাসে এই কারখানায় নতুন করে লোকবল নিয়োগও হয়নি। বরং যাঁরা চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন, তাঁদের স্থানে লোকও নেওয়া হয়নি।

পোশাক কারখানার একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হলো, প্রতি মাসেই কিছু কর্মী পূর্ব ঘোষণা না দিয়েই চাকরি ছেড়ে দেন। গত চার মাসে এমবি নিট ফ্যাশন লিমিটেড থেকে এমন প্রায় সাড়ে তিন শ শ্রমিক চলে গেছেন। তাঁদের শূন্যস্থান পূরণ করেনি মালিকপক্ষ।

বিনিয়োগ না হলে নতুন কর্মসংস্থান হয় না। ডলার–সংকটের কারণে উদ্যোক্তারা শিল্পকারখানা স্থাপনে কিংবা সম্প্রসারণে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি চিত্র থেকে এটা বেশ ভালো বোঝা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত জুলাই-ডিসেম্বরে আগের বছরের চেয়ে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি ৬৭ শতাংশ কমেছে।

এ বিষয়ে নিট পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, খরচ বেড়ে যাওয়ায় পোশাক খাতে কয়েক মাস ধরে নতুন নিয়োগ বন্ধ আছে। এমনকি কেউ চাকরি ছেড়ে চলে গেলেও সেই পদে নতুন কাউকে নেওয়া হচ্ছে না। প্রতি মাসে গড়ে ৫ থেকে ১০ শতাংশ শ্রমিক না জানিয়েই বাড়ি চলে যান।

মোহাম্মদ হাতেম আরও বলেন, এ মুহূর্তে পোশাক কারখানার মালিকেরা নতুন বিনিয়োগের চিন্তা করছেন না। এমনকি সম্প্রসারণও স্থগিত আছে। গ্যাস-বিদ্যুতের চলমান সংকট সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এমন পরিস্থিতি চলবে। এত খরচ করে টিকে থাকা সম্ভব নয়। প্রতি মাসেই সাত থেকে আটটি কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

কৃষি খাতের পর বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের বড় খাত হলো পোশাক খাত। ১ হাজার নিট পোশাক কারখানায় ১৪ থেকে ১৫ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। পুরো বস্ত্র খাতে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ শ্রমিক আছেন।

অনানুষ্ঠানিক খাত

অনানুষ্ঠানিক খাতে দেশের সিংহভাগ কর্মসংস্থান হয়। সেখানেও ভালো খবর নেই। যখন-তখন কাজ হারানো অনানুষ্ঠানিক খাতের নিত্য ঘটনা। কয়েক মাস ধরে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে এই অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকেরা সবচেয়ে বেশি কষ্ট আছেন।

অনানুষ্ঠানিক খাতের অন্যতম হলো পরিবহন। পরিবহন খাতের কর্মসংস্থানের বড় অংশ রাজধানী ঢাকায়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্রে জানা যায়, গত তিন বছরে বাস, ট্রাক, সিএনজি, টেম্পো, ট্যাক্সিক্যাব নিবন্ধন ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। এর অর্থ, পরিবহন খাত আগের মতো গতিশীল নয়, নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে। পাঁচ বছর আগের হিসাবে, পরিবহন খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৬০ লাখ লোক কাজ করেন।

আবার কোভিডের কারণে হোটেল–রেস্তোরাঁ ব্যবসা ভালো যায়নি। অনেক খাবারের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। পর্যটন ব্যবসাও এখনো আগের মতো চাঙা হয়নি। কৃষি ও শিল্পকারখানার পর হোটেল–রেস্তোরাঁ এবং সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হয়। বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি সূত্রে জানা জানা যায়, কোভিডের আগে রাজধানীতে প্রায় ২০ হাজার রেস্তোরাঁ ছিল। এখন তা কমে ১৬ হাজারে নেমে এসেছে।

এ বিষয়ে সমিতির প্রধান উপদেষ্টা খন্দকার রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোভিডের পর থেকে এমনিতেই রেস্তোরাঁ ব্যবসা খারাপ। এখন গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ানোর ফলে টিকে থাকা যাচ্ছে না। বহু রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় নতুন কর্মসংস্থান তো দূরের কথা, রেস্তোরাঁ বন্ধ করার কারণে কর্মীদের ছাঁটাই করতে বাধ্য হচ্ছি।’

তবে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে, তা মানতে নারাজ পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিগগিরই শ্রমশক্তি জরিপের ফলাফল হাতে পাব, তখন কর্মসংস্থান পরিস্থিতির পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যাবে। তবে ব্যবসায়ীরা যেভাবে বলেন, পরিস্থিতি ততটা খারাপ নয়। আমাদের কাছে তথ্য নেই, তা ঠিক নয়। দেশে এখন উল্টো অভিবাসন চলছে। শহর থেকে গ্রামে মানুষ যাচ্ছে। গ্রামের শ্রমবাজারে কাজ আছে। কৃষি খাতে সারা বছর কর্মসংস্থান হয়। এক বেলা খাইয়ে কমপক্ষে ৬০০ টাকা মজুরি না দিলে শ্রমিক পাওয়া মুশকিল।’

শামসুল আলম আরও বলেন, ‘গত এক বছরে মজুরি মোট ২৬ শতাংশ বেড়েছে। যদি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কাজ প্রত্যাশী থাকত, তাহলে মজুরি এত বাড়ত না। কোভিড ও বৈশ্বিক অর্থনীতির সংকটের প্রভাব আমাদের গ্রামের অর্থনীতিতে কম পড়েছে।’

বিনিয়োগের চিত্র

নতুন কোম্পানি, ফার্ম, অংশীদারি প্রতিষ্ঠান—এসবের নিবন্ধন আগের চেয়ে কমেছে। তিন বছর ধরেই এই প্রবণতা চলছে। যৌথমূলধনি কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৮২৬টি কোম্পানি, ফার্ম, অংশীদারি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন নিয়েছে। ওই বছরের তুলনায় পরের বছর নিবন্ধন সংখ্যা দেড় হাজার কমেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে মাত্র ৬ হাজার ৫৭৬টি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন নিয়েছে। এর মানে হলো, উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে আগ্রহ কমেছে, যা কর্মসংস্থানে প্রভাব ফেলেছে।

তবে উল্টো চিত্রও দেখা গেছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) হিসাবে, ২০২২ সালে সব মিলিয়ে ৪৬ হাজার ৮৪২ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। ২০২১ সালে এর পরিমাণ ছিল ৪০ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। কিন্তু এসব বিনিয়োগ প্রস্তাব বাস্তবে কার্যকর হতে কয়েক বছর সময় লাগে।

চাকরির বিজ্ঞাপন কমেছে ২০ শতাংশ

চাকরি খোঁজার অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোয় চাকরির বিজ্ঞাপন প্রচার কমেছে। গত কয়েক মাসে নিয়োগকর্তা প্রতিষ্ঠান এসব প্ল্যাটফর্মে চাকরির বিজ্ঞাপন দেওয়া কমিয়ে দিয়েছে।

চাকরি খোঁজার জন্য দেশের অন্যতম অনলাইন প্ল্যাটফর্ম হলো বিডিজবসডটকম। বিডিজবসডটকম সূত্রে জানা যায়, গত জুলাই-সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে বিডিজবসে প্রায় ২০ হাজার কর্মখালির বিজ্ঞাপন এসেছিল। পরের তিন মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) প্রায় ২০ শতাংশ বিজ্ঞাপন কমেছে। ওই ৩ মাসে ১৬ হাজার কর্মখালির বিজ্ঞাপন এসেছে। গত জানুয়ারিতেও বিজ্ঞাপন কম এসেছে।

এ বিষয়ে বিডিজবসডটকমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এম কে এম ফাহিম মাশরুর প্রথম আলোকে বলেন, বহু কোম্পানি এখন খরচ কমাচ্ছে। আবার নতুন বিনিয়োগও আসছে না। এ কারণে চাকরির বাজারের খারাপ অবস্থা। ডলার–সংকট ও জ্বালানি তেলের দাম স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত চাকরির বাজার ঠিক হবে না। এখন কোম্পানির বিক্রয়, পরিচালনা, তথ্যপ্রযুক্তি—এসব খাতেই কর্মখালি বিজ্ঞাপন বেশি আসে। উচ্চপদের জন্য বিজ্ঞাপন আসা কমে গেছে।

আগামী অক্টোবর-নভেম্বরের আগে চাকরির বাজার ঠিক হবে না বলে মনে করেন ফাহিম মাশরুর।

কর্মসংস্থান ও আয়-ব্যয়ের জরিপ হয়নি ৫ বছর

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ দিয়েই কর্মসংস্থানের প্রকৃত পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সবশেষ শ্রমশক্তি জরিপ করেছিল। কয়েক মাস আগে শ্রমশক্তি জরিপের মাঠপর্যায়ের তথ্য সংগ্রহ করেছে বিবিএসের শিল্প ও শ্রম শাখা। শিগগিরই এই জরিপের ফলাফল চূড়ান্ত করা হবে। তখন দেশের কর্মসংস্থান, বেকার পরিস্থিতি, শ্রমশক্তি—এসব বিষয়ে পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যাবে। তবে এই জরিপে কোভিডের সময় দেশের শ্রমবাজারে যে সংকট তৈরি হয়েছিল, তা উঠে আসবে না।

এ বিষয়ে বিবিএসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, চার বছর পরপর করার কথা থাকলেও কোভিডের কারণে জরিপটি করতে বিলম্ব হয়েছে। অন্যদিকে খানা আয় ও ব্যয় জরিপের তথ্য মাঠপর্যায় থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে তা চূড়ান্ত করা হবে। তখন মানুষের আয়, দারিদ্র্য—এসব চিত্র উঠে আসবে।

পাঁচ বছর আগের হিসাবে, দেশের কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ছিল ৫ কোটি ৯৫ লাখ। কাজের উপযুক্ত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ২১ লাখ। সেই হিসাবে বেকারের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৬ লাখ। তবে এই চিত্র যে এখন অনেকটাই পাল্টেছে, বাস্তব পরিস্থিতি সেদিকেই ইঙ্গিত করছে।