কত দেশ এখন মন্দার শঙ্কায়

ছোট–বড় কিংবা উন্নত-অনুন্নতনির্বিশেষে বিশ্বের বহু দেশ এখন প্রবল অর্থনৈতিক সংকট ও মন্দার ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি পরপর দুই প্রান্তিকে, আর যুক্তরাজ্যের জিডিপি এক প্রান্তিকে সংকুচিত হয়েছে। এভাবে আগামী ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে বহু দেশ মন্দায় পড়তে পারে।

কোভিড-১৯ মহামারির প্রকোপ শেষ হতে না হতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ডামাডোল আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিতিশীলতাকে দীর্ঘায়িত করছে। কারণ, বিশ্বের অন্যতম খাদ্য জোগানদাতা রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় সরবরাহব্যবস্থায় মারাত্মক বিঘ্ন ঘটেছে। বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম তো বেড়েছেই। বদৌলতে দুনিয়াজুড়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে।

আবার মূল্যস্ফীতির তুলনায় মজুরির হার না বেড়ে বরং কমে যাওয়ায় অনেক দেশেই জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের চাপ তো আছেই। এর ওপর মার্কিন ডলারের বিপরীতে নিজেদের মুদ্রার বিনিময় হারে ধস নামার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত ব্যাপক হারে কমে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে বহু দেশ। বৈদেশিক ঋণ লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে শ্রীলঙ্কার মতো বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতিতেই এখন টালমাটাল অবস্থা শুরু হয়েছে। এর ওপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে গিয়ে সরকারগুলো কিছু ভুল করবে, যা তাদের অর্থনীতিতে স্বস্তির পরিবর্তে বিপদ ডেকে আনতে পারে। সব মিলিয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে আরও একটি মন্দা ধেয়ে আসছে বলে মনে করা হচ্ছে।

জাপানের আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নোমুরা বলেছে, আগামী এক বছরের মধ্যে বিশ্বের বড় বড় অনেক অর্থনীতি মন্দায় পড়বে। এর আগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা কঠোর করতে গিয়ে কিছু ভুল করে বসবে, যা কিনা সংকট-মন্দা ত্বরান্বিত করতে পারে। সংকট-মন্দার ঝুঁকিতে থাকা উল্লেখযোগ্য উন্নত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা।

ঋণ সংকটের কারণে অর্থনৈতিক মন্দায় পড়তে পারে আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর, মিসর, এল সালভাদর, ইথিওপিয়া, ঘানা, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, তিউনিসিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ, লেবানন, রাশিয়া, সুরিনাম ও জাম্বিয়া।

অনেক পাঠকের মন এখন নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগতে পারে, মন্দা কী? অর্থনীতিবিদদের মতে, কোনো দেশে পরপর দুই প্রান্তিকে অর্থনীতি তথা মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) সংকুচিত হলে সেটাকে মন্দা বলা হয়।

সম্প্রতি জানা গেল, চলতি বছরের প্রথম দুই প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ ও এপ্রিল-জুন)যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে। কয়েক মাস ধরেই বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপকভাবে মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, গত চার দশকে সে দেশে এমন মূল্যস্ফীতি দেখা যায়নি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে টানা কয়েকবার নীতি সুদহার বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ। এরপরও যেভাবে জিডিপি সংকুচিত হচ্ছে, তাতে নাগরিকদের অনেকেরই ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি মন্দার দিকেই এগোচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়তে পারে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থানে।

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিলে এর প্রভাব পড়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে। যেমনটা দেখা গিয়েছিল ২০০৮-০৯ সালে। তখন আবাসন খাতের বন্ধকি ঋণের সংকট থেকে দেশটিতে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়, যা দ্রুতই বিশ্ব অর্থনীতিতে ছড়িয়ে পড়ে। তাই এবারও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে মন্দা দীর্ঘায়িত হলে এর প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিটির পর যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিও বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) শূন্য দশমিক ২ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। বর্তমান জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে অর্থনীতি সংকুচিত তথা নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হলেই মন্দায় পড়ে যাবে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিগুলোর একটি যুক্তরাজ্য। বছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশটিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ। তবে ওই প্রান্তিকের শেষ মাস, অর্থাৎ মার্চে সে দেশের অর্থনীতি শূন্য দশমিক ১ শতাংশ সংকুচিত হয়েছিল। এরপর এপ্রিলেও অর্থনীতি সংকুচিত হয়। তখনই ধারণা করা হয়েছিল, বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি অনেকাংশে সংকুচিত হবে।

যুক্তরাজ্যের জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থা অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকস (ওএনএস) জানিয়েছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সে দেশের মানুষ দৈনন্দিন ব্যয় কমানোর পাশাপাশি ভ্রমণও কমিয়েছে। মানুষ একেবারে প্রয়োজনীয় নয়, এমন সব ব্যয়ও করছে না। এমন অবস্থায় বিশ্লেষকেরা মনে করেন, যুক্তরাজ্যে আগামী অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১৩ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। সব মিলিয়ে দেশটিতে মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

নোমুরা হোল্ডিংসের মতে, একদিকে সরকারি নীতি কঠোর করা হবে, অন্যদিকে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়তে থাকবে। এরই মধ্য দিয়ে আগামী ১২ মাসের মধ্যে অনেকগুলো বড় অর্থনীতি মন্দায় প্রবেশ করবে, যা প্রকারান্তরে বিশ্ব অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ঠেলে দেবে। নোমুরার দুই গবেষক রব সুব্বারমান ও সি ইং তোহ এক প্রতিবেদনে এমন পূর্বাভাস দিয়েছেন।

রব সুব্বারমান ও সি ইং তোহ বলেন, ‘বিশ্ব অর্থনীতি একটি সুসংগত প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরিবর্তে মন্দার দিকে এগোচ্ছে। এই লক্ষণ দিন দিন জোরালো হচ্ছে। এর অর্থ দেশগুলো আর প্রবৃদ্ধির জন্য রপ্তানি খাতের ঘুরে দাঁড়ানোর ওপর নির্ভর করতে পারছে না। এটি আমাদের মন্দার পূর্বাভাস দিতে প্ররোচিত করেছে।’

এখনো উচ্চ মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, মূল্যস্ফীতির চাপ ছাড়াও বিভিন্ন পরিষেবার বিল ও পণ্য পরিবহনের ভাড়া বাড়ছে, আবার মজুরি কমছে।

নোমুরা বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলতি বছরের শেষ প্রান্তিক থেকে শুরু করে পাঁচটি প্রান্তিকে মন্দার পূর্বাভাস দিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এই মন্দা তেমন একটা তীব্র হবে না বলে সংস্থাটি মনে করে। অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন, যদি রাশিয়া সম্পূর্ণভাবে ইউরোপে গ্যাস বন্ধ করে দেয়, তাহলে ইউরোপে মন্দা আরও গভীর হতে পারে।

দেশগুলোর মধ্যে মন্দার তীব্রতায় তারতম্য থাকতে পারে। নোমুরা বলছে, ২০২৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরো উভয় অঞ্চলের অর্থনীতি ১ শতাংশ সংকুচিত হতে পারে। মাঝারি আকারের অর্থনীতিগুলো সম্পর্কে বলা হয়েছে, যদি সুদের হার বেড়ে গিয়ে হাউজিং তথা আবাসন খাতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে, তাহলে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোতে গভীর মন্দা দেখা দেওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই ও সবচেয়ে তীব্র মন্দা আঘাত করতে পারে দক্ষিণ কোরিয়ায়। দেশটির অর্থনীতি চলতি বছরের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ২ দশমিক ২ শতাংশ সংকুচিত হতে পারে।

চলমান নীতি সমর্থন ও বিলম্বিত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার মধ্যে জাপানে মৃদু মন্দা দেখা দিতে পারে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে শূন্য কোভিড নীতিসহ সংকুলানমূলক নীতিমালা গ্রহণ করে চীন মোটামুটি নিরাপদ অবস্থানে রয়েছে বটে, তবে দেশটি এখনো লকডাউন বা বিধিনিষেধের ঝুঁকিতে রয়েছে।

গভীর সংকটের ঝুঁকিতে আরও যেসব দেশ

মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত ব্যাপক হারে কমে যাওয়া, বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণেও অনেক দেশ এখন গভীর অর্থনৈতিক সংকট-মন্দার ঝুঁকিতে রয়েছে। এগুলো বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর, মিসর, এল সালভাদর, ইথিওপিয়া, ঘানা, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, তিউনিসিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ, লেবানন, সুরিনাম ও জাম্বিয়া।

রাশিয়ান রুবল ও ব্রাজিলের রিয়েল ছাড়া বিশ্বের আর প্রায় সব মুদ্রার বিপরীতেই এ বছর মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে। এখন বহু দেশের স্থানীয় মুদ্রার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম বিগত দুই দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। ডলারের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন দেশকে আন্তর্জাতিক বাজারে, অর্থাৎ আমদানি ব্যয় পরিশোধে বেশি পরিমাণে অর্থ ঢালতে হচ্ছে। কারণ, বেশির ভাগ মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা তলানিতে নেমে গেছে। এতে দেশগুলোয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়ছে। ফলে অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা জোরালো হয়ে উঠছে।

রয়টার্সের মতে, বৈদেশিক ঋণ নিয়ে সংকটের কারণে রেকর্ডসংখ্যক উন্নয়নশীল দেশ বর্তমানে অসুবিধার মধ্যে রয়েছে। কারণ, বেশ কয়েকটি দেশে এখন শ্রীলঙ্কার মতো অর্থনৈতিক অস্বস্তি পরিলক্ষিত হচ্ছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান বলেছেন, শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট উচ্চ ঋণসহ অন্যান্য দেশগুলোর জন্য সতর্কতার ইঙ্গিত।

ঋণ পরিশোধের ক্রমবর্ধমান চাপ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি—সবই অর্থনৈতিক পতনের লক্ষণ। শ্রীলঙ্কার মতো লেবানন, রাশিয়া, সুরিনাম ও জাম্বিয়া ইতিমধ্যে ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে। ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধের পরিস্থিতিতে রাশিয়ার পক্ষ নিয়ে বেলারুশ ইইউর নিষেধাজ্ঞায় পড়ে খেলাপি হওয়ার পথে আছে। এ ছাড়া আরও অন্তত এক ডজন দেশ ঋণখেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

সূত্র: এনডিটিভি, সিএনবিসি, দ্য গার্ডিয়ান