পতনের দ্বারপ্রান্তে মিয়ানমারের অর্থনীতি

মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুথানের পর দেশটির সাবেক রাজধানী ইয়াঙ্গুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাইরে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভের এই ছবি গত বছরের ফেব্রুয়ারির
ছবি: রয়টার্স

ইউরোপের দেশ আলবেনিয়ার নেতা আনোয়ার হোজা একবার চীনের নেতা মাও সে–তুংয়ের কাছে চিঠি লিখলেন, ‘কমরেড, আমার দেশের মানুষ না খেয়ে আছে। অতি দ্রুত খাবার পাঠান।’ জবাবে কমিউনিস্ট মিত্রকে মাও লিখলেন, ‘কমরেড আনোয়ার, আমাদের দেশের অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। খাবার পাঠাতে পারছি না। দয়া করে আপনার লোকদের বলুন, কোমরের বেল্ট শক্ত করে এঁটে বাঁধতে। এতে ক্ষুধার কিছুটা উপশম হতে পারে।’ এবার আনোয়ারের পাল্টা চিঠি, ‘কমরেড মাও। আমাদের দেশে বেল্টও নেই। দয়া করে বেল্ট পাঠান।’

গল্পটি স্নায়ুযুদ্ধকালের। তবে একালে মিয়ানমারের অবস্থাও কাছাকাছি। দেশটির সামরিক জান্তা সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং কোনো বন্ধুদেশের কাছে এমন চিঠি লিখেছেন কি না জানা যায়নি। তবে তিনি জনগণকে কম খেতে বলছেন। কারণ, কম খাওয়া নাকি স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো!

শুরুতে দেশটির একজন সাধারণ মানুষের গল্প শুনে আসা যাক। মিয়ানমারের সাবেক রাজধানী ইয়াঙ্গুনে একটি অফিসে চাকরি করেন ৩৫ বছর বয়সী মা আয়ে। সকালে অফিসে গিয়ে পাশের কোনো চায়ের দোকান থেকে নাশতাটা সেরে নিতেন তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে তাঁকে দীর্ঘদিনের অভ্যাস বদলে ফেলতে হয়েছে। এখন তিনি সকালে নাশতা করেন না, দুপরের খাবারটা একটু আগে খেয়ে নেন, যা তিনি তৈরি করে নিয়ে আসেন বাসা থেকে। এভাবে এক বেলা না খেয়ে কিছুটা ব্যয় সাশ্রয় করছেন এই নারী। মা আয়ে তবু নিজেকে ধন্যবাদ দেন, কারণ তার চাকরিটা এখনো টিকে আছে। চোখের সামনে দেখেছেন চাকরি হারিয়ে সহকর্মীদের অনেকে বেকার হয়ে গেছেন।

সবুজঘেরা দেশ মিয়ানমার। বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিবেশী। বনজ ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ দেশটির জনসংখ্যা সাড়ে পাঁচ কোটি। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর দীর্ঘ সেনাশাসনে পিষ্ট দেশটি। স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশরা, স্বাধীনতার পরে রাশিয়া দেশটির বেশ কিছু অবকাঠামো তৈরি করে দেয়। পরবর্তী সময়ে চীন ও ভারত দেশটিতে বিনিয়োগ করে। তবে এসব বিনিয়োগে দেশটির সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এর মধ্যে ২০১৫ সালে গণতান্ত্রিক শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত ছিল দেশটির। চীন, রাশিয়া, ভারত, জাপান ও জার্মানির কিছু বড় বড় প্রতিষ্ঠান সে দেশে গিয়েছিল ব্যবসা খুলতে। কিন্তু ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আবার অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে সামরিক শাসন জারি করেন সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং। এরপর দেশটির ওপর নেমে আসে পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক অবরোধ। স্থগিত হয়ে যায় বৈদেশিক সহায়তা। অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী তাদের লগ্নি প্রত্যাহার করে নেয়।

দুই বছর করোনার অভিঘাতে বিপর্যস্ত অর্থনীতি যখন একটু একটু ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করছিল, তখন আচমকা স্থবিরতা নেমে আসে দেশটির অর্থনীতিতে। দিন যতই যাচ্ছে, পরিস্থিতির কেবল অবনতি হচ্ছে। মিয়ানমার অনেক আগে থেকেই একটি বিশৃঙ্খলাপূর্ণ দেশ। সামরিক শাসন জারির পর যা আরও মাথাচাড়া দিয়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো নিজ নিজ এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সশস্ত্র তৎপরতা চালাচ্ছে। আবার সেনাবাহিনীও চাচ্ছে, পুরো দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে। যার ফলে দেশজুড়েই এক নৈরাজ্য পরিস্থিতি। অনেক স্থানে যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত। ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশও নেই।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশটির নির্মাণ খাত, তৈরি পোশাক, পর্যটন ও সেবা খাত। একই সঙ্গে গ্রামীণ কৃষকেরাও তীব্র সংকটে আছেন। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক মিলিয়ে ২০২০ সালে দেশটিতে শ্রমে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৫০ লাখ। কিন্তু এক বছরে (২০২১ সালে) কাজ হারিয়েছেন ১৬ লাখ মানুষ, যা মোট শ্রমশক্তির ৮ শতাংশ।

একই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালের শেষে দেশটির জনসংখ্যার অর্ধেক বা প্রায় আড়াই কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছেন। এর মধ্যে ১ কোটি ৪৪ লাখ মানুষের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। ইয়াঙ্গুন, মান্দালয়সহ বড় বড় শহরের রাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি থামলেই একটা পয়সার জন্য হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে শিশুরা। ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক শিশুর লেখাপড়া। ডলারের তুলনায় মিয়ানমারের মুদ্রা কিয়াটের মূল্যপতন চলছেই। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি যেদিন জান্তা সরকার ক্ষমতা দখল করে,

সেদিন প্রতি ডলারে পাওয়া যেত ১ হাজার ৩৯৫ কিয়াট। গত শনিবার রাতে এ প্রতিবেদন লেখার সময় ১ ডলারের জন্য দিতে হচ্ছে ২ হাজার ১১৩ কিয়াট।

ব্রিটিশ ম্যাগাজিন ইকোনমিস্ট–এর তথ্য অনুসারে, কিয়াটের পতন ঠেকাতে সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের রিজার্ভের ১০ শতাংশ বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়। গত এপ্রিল থেকে দেশটির রিজার্ভ কমতে থাকে। কারণ, বিদেশি বিনিয়োগ, বিদেশি সহায়তা ও প্রবাসী আয় কমতে শুরু করে। অন্যদিকে বাড়তে থাকে নিত্যপণ্যের দাম। এ অবস্থায় জান্তা সরকার মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে রিজার্ভ ধরে রাখার চেষ্টা করে। এতে দেশটিতে ডায়াবেটিস ও ক্যানসারের ওষুধের মতো জরুরি পণ্যেরও ঘাটতি দেখা দেয়।

খাদ্যসংকট তীব্র

একসময় চাল উৎপাদনে বিশ্বে ওপরের দিকে থাকা দেশ মিয়ানমার এখন খাদ্যসংকটে ভুগছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছর দেশটির প্রায় ১৩ লাখ মানুষ মাঝারি বা তীব্রভাবে খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকিতে রয়েছেন। দেশটিতে একদিকে কমছে সাধারণ মানুষের আয়, অন্যদিকে খাদ্য ও কৃষিজাত সামগ্রীর দাম বাড়ছে। বাড়তি ব্যয় সামাল দিতে গরিব মানুষকে ঋণ করতে হচ্ছে। মানুষকে সঞ্চয় ভাঙতে হচ্ছে, এমনকি সম্পদও বিক্রি করতে হচ্ছে। গত ১ ফেব্রুয়ারি সেনা অভ্যুত্থানের পর ব্যাংক থেকে অর্থ তুলতে নাগরিকদের লাইনে দাঁড়াতে হয়েছিল, কেউ কেউ সোনাও কিনেছিলেন। আর এখন অনেকেই সোনা বিক্রি করে দিতে চাচ্ছেন।

দেশটিতে কম খাওয়া বা এক বেলা না খেয়ে থাকা মানুষের সংখ্যা ২০২০ সালের তুলনায় এ বছর ১০ শতাংশ বেড়ে ৩৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মিয়ানমারে এখন ৪৮ কেজির এক বস্তা চাল কিনতে লাগছে ৪৮ হাজার কিয়াট, এ দাম সেনা অভ্যুত্থানের আগের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিপর্যয়

মিয়ানমারের বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেকটাই হাইড্রোপাওয়ার বা জলবিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। বলা হয়ে থাকে, প্রায় ৪০ হাজার মেগাওয়াটের জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে দেশটির। অনেকগুলো বিদেশি কোম্পানি এ খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছিল। তবে সামরিক শাসনের কারণে কোম্পানিগুলো এখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বর্তমানে দেশটি তীব্র বিদ্যুৎ–সংকটে আছে।

শুকনো মৌসুমে অবস্থা আরও শোচনীয় হয়। লোডশেডিং ছিল অবধারিত। অনেক কারখানার চাকা ঘোরেনি। কো ও নামে এক ব্যবসায়ী ডয়চে ভেলেকে বলছিলেন, যতক্ষণ বিদ্যুৎ আছে, ততক্ষণ তিনি উৎপাদন করছেন। বিদ্যুৎ চলে গেলে কারখানা বন্ধ। কারণ, গ্যাসোলিনের যে দাম, তা দিয়ে জেনারেটর চালু করে উৎপাদন অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়। তাই বিদ্যুৎ–সংকটের কারণে তার কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা অনেক কমে গেছে।

তা ছাড়া হাজারো সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা সামরিক অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে, অং সান সু চির এনএলডি সরকারের সমর্থনে অহিংস আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। এ আন্দোলনের অংশ হিসেবে তাঁদের কেউ কেউ বিদ্যুৎ বিল দিচ্ছেন না, কেউ কর দিচ্ছেন না। এতে সামরিক সরকারের রাজস্ব সংগ্রহ একেবারেই তলানিতে নেমেছে। সম্প্রতি দেশটিতে পেট্রলের দাম বেড়েছে ২১ শতাংশ, আর ডিজেলের ২৯ শতাংশ। সামরিক অভ্যুত্থানের পর রান্নার তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে তিন দফায়। তাই সাশ্রয়ী মূল্যে এক বোতল রান্নার তেলের জন্য ইয়াঙ্গুনের রাস্তায় দীর্ঘ লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেন সাধারণ বার্মিজরা।

সংকটে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য

মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধান উপাদান তৈরি পোশাক খাত। ২০১১ সালে পোশাক খাত থেকে দেশটির আয় ছিল ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার, ২০১৯ সালে যা বেড়ে হয় সাড়ে ৬ বিলিয়ন বা ৬৫০ কোটি ডলার। কিন্তু এখন দেশটির পোশাক খাত ধুঁকছে। এ খাতের হাজারো কর্মীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এইচঅ্যান্ডএম, বেনেটন, প্রাইমার্কের মতো বিশ্বখ্যাত পোশাকের ব্র্যান্ডগুলো মিয়ানমার থেকে পোশাকের ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিয়েছে। আবার কেউ কেউ মিয়ানমারের সঙ্গে ব্যবসাও স্থগিত রেখেছে।

নরওয়ের বিশ্বখ্যাত টেলিকম প্রতিষ্ঠান টেলিনর মিয়ানমার থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের কথা ভাবছে। কোকা–কোলা, টেলিনর, হেনিকেনসহ ৫০টি বহুজাতিক কোম্পানি এরই মধ্যে মিয়ানমারের বিদ্যমান ব্যবসায়িক

পরিবেশ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জার্মান হোলসেলার মেট্রো, ব্রিটিশ–আমেরিকান টোব্যাকো, ভারতের আদানি গ্রুপও বিনিয়োগ প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে। কেবল জাপানি কোম্পানিগুলো এখনো মিয়ানমার থেকে ব্যবসা সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে কিছু জানায়নি। বহুজাতিক কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান দেশটির ২০২৩ সালের নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চায়।

এদিকে দেশটির জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং গত দেড় বছরে তিনবার রাশিয়া গেছেন। সর্বশেষ চলতি মাসের শুরুতে গেছেন পূর্বাঞ্চলীয় শহর ভ্লাদিভস্তকে, ইস্টার্ন ইকোনমিক ফোরামের সম্মেলনে যোগ দিতে। রাশিয়ার সঙ্গে ‘বিশেষ সম্পর্ক’ তৈরি করাই তাঁর বারবার দেশটি সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, ১৯৯৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার কাছ থেকে আনুমানিক দেড় বিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম কিনেছে মিয়ানমার, যা দেশটির মোট অস্ত্র আমদানির ৩৯ শতাংশ।

উত্তরণের উপায়

ব্যয় বা ভোগ কমিয়ে, অভ্যন্তরীণ জ্বালানি তেল ও খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়িয়ে এবং রাষ্ট্রীয় কারখানাগুলো পুনরায় চালু করে জান্তা সরকার একধরনের নিজস্ব শক্তি দেখানোর চেষ্টা করছে দেশটিতে। ইকোনমিস্ট–এর ভাষায়, মিন অং হ্লাইংসহ যাঁরা এখন জোর করে দেশ চালাচ্ছেন, তাঁরা সবাই অর্থনৈতিকভাবে অশিক্ষিত।

ছয়জন সামরিক কর্তাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মিন অং হ্লাইংয়ের ঘনিষ্ঠ লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো মিন্ত তুনকে বানানো হয়েছে বিনিয়োগ কমিশনের প্রধান। তাঁরা নতুন একধরনের ব্যবসায়ী গোষ্ঠী তৈরি করতে যাচ্ছেন। পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, মিয়ানমারের অর্থনীতির চাকা আবার সচল করতে দরকার একাধিক পুনরুদ্ধার কর্মসূচি। কিন্তু জান্তা সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো ভাবনা বা উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।