করব্যবস্থা সহজ ও স্বয়ংক্রিয় করার দাবি ব্যবসায়ীদের

অর্থনীতিতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জের বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বাজেট প্রণয়নে পরামর্শ দিয়েছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা।

করব্যবস্থা সহজ ও স্বয়ংক্রিয় করার দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা। তাঁরা বলছেন, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অর্থনীতি সংকুচিত হচ্ছে। ডলার–সংকট ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যবসা কঠিন হয়ে পড়েছে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে ব্যবসার খরচ বেড়েছে। অন্যদিকে ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় যুক্ত হলে নতুন চ্যালেঞ্জ আসবে। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করতে হবে।

ঢাকা চেম্বার, সমকাল ও চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘প্রাক্-বাজেট আলোচনা ২০২৩-২৪: বেসরকারি খাতের প্রত্যাশা’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় ব্যবসায়ী নেতারা এসব কথা বলেন। গতকাল বুধবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।

আরও উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম, সংসদ সদস্য মো. শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন, সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি সামির সাত্তার।

পাকিস্তানের চেয়ে সব সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে। তবে কর-জিডিপির অনুপাতে পাকিস্তানের চেয়ে পিছিয়ে। এটা লজ্জার বিষয়। এনবিআরের অটোমেশন ছাড়া কর-জিডিপি বাড়বে না।
সালমান এফ রহমান প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা

সালমান রহমান বলেন, ‘পাকিস্তানের চেয়ে সব সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে। তবে কর-জিডিপির অনুপাতে আমরা পাকিস্তানের চেয়ে পিছিয়ে। এটা লজ্জার বিষয়। এনবিআরের অটোমেশন ছাড়া কর-জিডিপি বাড়বে না। তিনি বলেন, আমাদের করকাঠামোতে সমস্যা আছে। সেটি হচ্ছে আমাদের করব্যবস্থা অনেক বেশি পরোক্ষ করনির্ভর।’

ছোট ব্যবসায়ীরা কর দিতে চান না বলে অভিযোগ করে সালমান এফ রহমান বলেন, ব্যবসায়ীরা নিজেদের ওপর চাপ কমানোর জন্য করজাল বাড়ানোর কথা বলেন। কিন্তু ছোট ব্যবসায়ীরা কর দিতে চান না। যাঁদের আয় করযোগ্য, তাঁদের সবাইকে কর দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, আগামী জুনের মধ্যে ডলারের বিনিময় হার একটিতে নামিয়ে আনা হবে। ব্যাংকঋণের সুদহারও বাজারভিত্তিক করা হবে।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি সংকুচিত হচ্ছে কথাটি ঠিক নয়। আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কখনোই ঋণাত্মক হয়নি। প্রবাসী আয়, রপ্তানি, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ও বেসরকারি খাতের ঋণ প্রভাব ইতিবাচক ধারায় আছে। খাদ্যনিরাপত্তা আমরা অপূর্বভাবে রক্ষা করছি।’ তিনি আরও বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটে এডিপি (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) সেভাবে বাড়বে না। সেটিকে সাশ্রয়ী ও যৌক্তিক করার চেষ্টা থাকবে। তা ছাড়া সরকারের ঋণ যেন না বাড়ে, সেই লক্ষ্যও থাকবে।

বাজেট আলোচনায় সরকারের উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, ব্যবসায়ী নেতা ও দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠীর শীর্ষ নির্বাহীরা উপস্থিত থাকলেও অর্থ মন্ত্রণালয় বা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কোনো কর্মকর্তা ছিলেন না। আয়োজকেরা জানান, এনবিআর চেয়ারম্যানকে আলোচনায় বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।

এ বিষয়টিকে সামনে এনে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ব্যবসায়ীদের কথা এনবিআরকে শুনতে হবে। প্রতিষ্ঠানটির মনোভাবে পরিবর্তন আনতে হবে। বিতর্কের মাধ্যমেও সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, জ্বালানি খাতে সরকার ভর্তুকি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এত দিন জ্বালানি খাত থেকে যে শুল্ক-কর আদায় হতো, তাই ভর্তুকি আকারে ফিরিয়ে দেওয়া হতো। এখন ভর্তুকি না থাকলে করও তুলে দিতে হবে। 

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, ‘তৈরি পোশাকের বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। তবে আমাদের ঝুট কাপড় আমদানি নিষিদ্ধ। সৌরবিদ্যুতের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আমদানিতে উচ্চ শুল্ক রয়েছে। এসব বিষয়ে উদার হতে হবে।’

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি আমাদের চাপে রেখেছে। জনগোষ্ঠীর একটি অংশ যদি খাদ্যনিরাপত্তায় পড়ে, তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্যেও তার প্রভাব পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের দুই ব্যাংক বন্ধ হয়েছে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী বলেন, ‘বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের সামগ্রিক পণ্য রপ্তানি বাড়াতে হবে। সে জন্য বন্ড সুবিধার আওতা বৃদ্ধি ও করব্যবস্থা সহজ করতে হবে। আমরা উত্তরবঙ্গের মানুষ। উত্তরবঙ্গে নাকি বন্ড সুবিধা দেওয়া যাবে না। তার কারণ, আমরা সীমান্তের কাছাকাছি। ফলে উদারভাবে চিন্তা করার সময় এসেছে।’

সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদদের সংগঠন আইসিএবির সাবেক সভাপতি হুমায়ূন কবির বলেন, করব্যবস্থা ডিজিটালাইজেশনে রাষ্ট্রের যেসব পয়সা খরচ করা হয়েছে, তার জবাবদিহি নেই। এনবিআরকে শুধু রাজস্ব আদায় নয়, খরচেও যৌক্তিক হতে হবে।

আলোচনায় আরও বক্তব্য দেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান, ইউনিলিভার বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাভেদ আখতার, সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন, আব্দুল মোনেম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাঈনুদ্দিন মোনেম, নকিয়া বাংলাদেশের কান্ট্রি হেড আরিফ ইসলাম, বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী, শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান আরিফ খান প্রমুখ।