দেশের অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছিল এক প্রান্তিকে

কোভিড মহামারির সময় বাংলাদেশের অর্থনীতি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তার একটি চিত্র পাওয়া গেছে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিসংখ্যান থেকে। করোনা মহামারির প্রথম ধাক্কার সময় ২০২০ সালের এক প্রান্তিকে অর্থনীতি সাড়ে ৭ শতাংশের বেশি সংকুচিত হওয়ার ঘটনা ঘটে। তবে পরের প্রান্তিকেই অর্থনীতির পুনরুদ্ধার হওয়ার যে তথ্য সরকারিভাবে দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশের এক দশকের বেশি সময় ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে ছিল। একসময় তা ৭ শতাংশ পেরিয়ে ৮ শতাংশ ছুঁই ছুঁই করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বার্ষিকভিত্তিতে প্রবৃদ্ধি কখনোই নেতিবাচক হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিসংখ্যান বলছে, কোভিডের শুরুতে বড় ঝাঁকুনি খেয়েছিল দেশের অর্থনীতি।

বিবিএস প্রথমবারের মতো ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপির চিত্র প্রকাশ শুরু করেছে। সেখানেই প্রথম উঠে আসে, ২০২০ সালে করোনার শুরুর সময়ে অর্থাৎ এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে প্রথমবারের মতো দেশের অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছিল। ওই প্রান্তিকে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় জিডিপির আকার ৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ কমে গিয়েছিল; অর্থাৎ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল।

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর ২০২০ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশে প্রথম ‘লকডাউন’ দেওয়া হয়। সরকার কয়েক দফায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। শুরুতে প্রায় দুই মাসের মতো ‘লকডাউন’ পরিস্থিতি ছিল। তখন প্রায় সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ অথবা স্থবির ছিল।

ওই অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৯–২০ সালে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছিল ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। তবে প্রথমবারের মতো ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপির হিসাব প্রকাশ করার কারণে কোভিডের প্রথম ধাক্কার ‘লকডাউনের’ সময়টিতে অর্থনীতির পরিস্থিতি কী হয়েছিল, তা জানা সম্ভব হয়েছে।

ঠিক দুই বছর পরে একই প্রান্তিকে অর্থাৎ ২০২২ সালের এপ্রিল-জুন সময়েও বাংলাদেশের অর্থনীতি আরেকবার সংকটের মুখোমুখি হয়। তখন থেকেই অর্থনীতিতে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়া শুরু করে। ওই প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি দুইয়ের ঘরে নেমে এসেছিল।

কোভিডের প্রথম তিন মাস

সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে জুন—এই তিন মাসেই অর্থনীতিতে কোভিডের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছিল। ‘লকডাউনের’ কারণে সে সময় যানবাহন চলেনি। মানুষ বাইরেই বেরিয়েছে খুব কম। দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান প্রথম কিছুদিন প্রায় বন্ধই ছিল বলা চলে। অর্থনীতির গতি ছিল মন্থর।

বিবিএস বলছে, ওই তিন মাসে অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন হয়েছে ৬ লাখ ৩১ হাজার ২৬২ কোটি টাকা। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৩ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা কম। এর মানে হলো, ওই প্রান্তিকে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে অর্থনীতি খারাপ চলেছে। ২০১৯ সালের এপ্রিল-জুন সময়ে অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন হয়েছিল ৬ লাখ ৮৫ হাজার ৯১ কোটি টাকা। এই হিসাবগুলো স্থিরমূল্যে করা হয়েছে।

১২টি খাত নিয়ে জিডিপি হিসাব করা হয়। ২০২০ সালের এপ্রিল-জুন সময়ে ১০টি খাত সংকুচিত হয়েছিল। এগুলো হলো কৃষি, শিল্পকারখানা, খনিজ সম্পদ, গ্যাস, বিদ্যুৎ, নির্মাণ, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসা, পরিবহন, হোটেল ও রেস্তোরাঁ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিল্প-সাহিত্য অঙ্গন।

প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছিল জনপ্রশাসন ও স্বাস্থ্য এবং আবাসন খাত।
পরের দুই প্রান্তিকেও অবস্থার খুব উন্নতি ঘটেনি, তবে অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির ধারায় ফেলে। পরের ছয় মাসে প্রবৃদ্ধি অবশ্য ১ শতাংশের কম ছিল। বিবিএসের হিসাব বলছে, ২০২০ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দশমিক ৮৫ শতাংশ এবং অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক প্রান্তিকে অর্থনীতি সংকুচিত হওয়ার পরের প্রান্তিকেই ইতিবাচক ধারায় ফিরে আসা তখনকার বাস্তবতার সঙ্গে অস্বাভাবিকই মনে হচ্ছে। অর্থনীতি এত দ্রুত পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় গেল কীভাবে?’
২০২১ সালের শুরু থেকে পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে শুরু করে। ২০২১ সালের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি হয় ৬ দশমিক ২১ শতাংশ।

তবে বিবিএসের হিসাবে, অর্থনীতি দারুণভাবে চাঙা হয় ওই বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে। ওই সময়ে প্রবৃদ্ধি এক লাফে ২১ দশমিক ৬৭ শতাংশে উঠে যায়। বিবিএস যে সাত অর্থবছরের (২০২১৫-১৬ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর) ২৮টি প্রান্তিকভিত্তিক জিডিপি তুলে ধরেছে, তাতে দেখা গেছে যে ওই প্রান্তিকেই সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবও উঠে এসেছে বিবিএসের হিসাবে। ২০২২ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন আক্রমণ করে রাশিয়া। ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে সংকট শুরু হয়। বিঘ্নিত হয় পণ্য সরবরাহব্যবস্থা, জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। ২০২২ সালের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৫৮ শতাংশে নেমে আসে। অথচ আগের দুই প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১০ শতাংশের বেশি।

এ বিষয়ে বিবিএসের মহাপরিচালক মো. মতিয়ার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে জিডিপির হিসাব শুরু করায় অর্থনীতির চিত্র আরও বিস্তারিতভাবে পাওয়া যাচ্ছে। কোভিডের সময় অর্থনীতির অবস্থা কিছুটা খারাপ হয়েছিল, তা উঠে এসেছে। ভবিষ্যতে জেলাওয়ারি জিডিপি প্রকাশের পরিকল্পনাও আমাদের আছে।

পরিবহনে এত মূল্য সংযোজন কীভাবে?

কোভিডের শুরুর দিকে ‘লকডাউন’ দেওয়ার ফলে পরিবহন ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়েছিল। জরুরি সেবা ছাড়া সব ধরনের যানবাহনের চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। দুই মাসের মতো এভাবেই চলে। ধীরে ধীরে খুলতে থাকে সব।

কিন্তু ওই প্রান্তিকে চলতি মূল্যে মূল্য সংযোজনের যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, তাতে দেখা গেছে, পরিবহন খাতে ‘লকডাউনের’ তেমন প্রভাব পড়েনি। যেমন ওই প্রান্তিকে পরিবহন ও মজুত খাতে মূল্য সংযোজন দেখা হয়েছে ৬৪ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে মাত্র ১ হাজার কোটি টাকা কম।

যানবাহন চলাচলে এত বিধিনিষেধ থাকার পর কীভাবে এত মূল্য সংযোজন হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এ বিষয়ে সিপিডির মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ওই সময়ে শিল্পকলকারখানা বন্ধ ছিল, মানুষের চলাচল প্রায় সীমিত ছিল। তাহলে পরিবহন খাতে এত মূল্য সংযোজন হলো কীভাবে? এই হিসাব মিলছে না।’

প্রথম দফার কোভিড ‘লকডাউনের’ পরের প্রান্তিকে দ্রুতই অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো এবং ওই সময়ে অর্থনীতিতে পরিবহন খাতের অবদানের বিষয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলমের সঙ্গে কথা বলে প্রথম আলো। তিনি বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন এভাবে: ‘অর্থনৈতিক কার্যক্রমের প্রতিফলন ঘটে জিডিপির হিসাবে। কোভিড শুরুর কিছুদিন পর প্রণোদনা দেওয়া হয়েছিল। সে জন্য অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতি সরল রেখায় চলে না। তাই ত্রৈমাসিক জিডিপির হিসাব দিয়ে অর্থনীতি বিবেচনা না করে বছর শেষে প্রবৃদ্ধি কত হলো, তা বিবেচনা করা উচিত।’

সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, প্রান্তিকভিত্তিক জিডিপি গণনা করা ভালো উদ্যোগ, তবে এ ক্ষেত্রে সঠিক হিসাব নিশ্চিত করাও প্রয়োজন। তিনি বলেন, ‘প্রান্তিকভিত্তিক জিডিপির হিসাবে অর্থনীতির হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায়। এক বছর অপেক্ষা করতে হয় না। তবে বিবিএসের সক্ষমতা না বাড়ালে প্রান্তিকভিত্তিক জিডিপির সঠিক হিসাব করা কঠিন।’