কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর্থিক সংকট তৈরি করবে কি

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) প্রভাব নিয়ে সারা বিশ্বেই এখন ব্যাপক তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। এবার সেই বিতর্কের আগুনে যেন ঘি ঢাললেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও লেখক ইউভাল নোয়াহ হারারি। যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে তিনি বলেছেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে ভয়াবহ আর্থিক সংকট হতে পারে পৃথিবীতে। তাঁর মতে, প্রযুক্তি যত উন্নত হবে, ততই এর বিপদ সম্পর্কে পূর্বাভাস পাওয়া কঠিন হবে।

দ্য গার্ডিয়ানের সঙ্গে আলাপচারিতায় নোয়াহ হারারি, এআই মডেলের নিরাপত্তা পরীক্ষা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। বিষয়টিকে কিছুটা পারমাণবিক বোমার সঙ্গে তুলনা করেন তিনি। বলেন, পারমাণবিক বোমার সঙ্গে এআইয়ের অমিল হলো, পারমাণবিক বোমার ঝুঁকি একটাই; কিন্তু এআইয়ের ঝুঁকি বহুবিধ, যদিও সেগুলোর সম্ভাবনা কম। হারারি জোর দিয়ে বলেন, এসব ঝুঁকি সম্মিলিতভাবে মানবসভ্যতার অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

তবে আশঙ্কার মধ্যেও কিছু আশার বাণী দিয়েছেন হারারি। তা হলো, চলতি মাসের শুরুতে যুক্তরাজ্যের বার্কিংহামশায়ারে অনুষ্ঠিত বৈশ্বিক এআই নিরাপত্তাবিষয়ক শীর্ষ সম্মেলনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যোগ দিয়েছিল। এআই–বিষয়ক উদ্বেগ আমলে নিতে বা এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ একত্র হয়েছে সম্মেলনে। হারারি মনে করেন, বৈশ্বিক পরিসরে সহায়তা ব্যতীত এআইয়ের বিপদ মোকাবিলা করা খুবই চ্যালেঞ্জিং। যুক্তরাজ্য সরকারের উদ্যোগে আয়োজিত এ সম্মেলনে ১০টি দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, গুগল, ওপেনএআইসহ বড় বড় এআই কোম্পানি এআই মডেল প্রকাশিত হওয়ার আগে ও পরে ঐক্যবদ্ধভাবে তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়ে একমত হয়েছে। যদিও চীন সে ঘোষণায় সই করেনি।

২০০৭-০৮ সালের আর্থিক সংকটের অন্যতম কারণ ছিল কোল্যাটেরালাইজড ডেট অবলিগেশন্স বা সিডিওর মতো কিছু দুর্বোধ্য আর্থিক হাতিয়ার। হারারি মনে করেন, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় এআইয়ের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলে এ ধরনের সমস্যা আরও বাড়বে, অর্থাৎ সিডিওর মতো দুর্বোধ্য বস্তু সৃষ্টি হবে। সেটা হলে আর্থিক ব্যবস্থা মানুষের বোধগম্যতার বাইরে চলে যাবে। পরিণামে যেটা হবে সেটা হলো, সংকটের সময় আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

আর্থিক সংকট থেকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হবে ঠিক, কিন্তু হারারি মনে করেন, এআইজনিত আর্থিক সংকটের কারণে মানবসভ্যতা ধ্বংসের মুখে না–ও পড়তে পারে। কিন্তু এআইয়ের কারণে পরোক্ষভাবে যুদ্ধ বা সংঘাত তৈরি হতে পারে, যা মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলার আশঙ্কা রয়েছে।

এআই মডেল দ্রুতই পরিবর্তিত হয় বা বদলে যায়। সে জন্য হারারির মত, এই ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে, যারা দ্রুত পরিবর্তনে সাড়া দিতে পারবে। হারারি মনে করেন, দীর্ঘ ও জটিল আইন তৈরি করার চেয়ে প্রাথমিকভাবে শক্তিশালী ও সক্ষম নিয়ন্ত্রক সংস্থা গড়ে তোলা জরুরি। কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘ ও জটিল এবং সাধারণত দেখা যায়, যত দিনে আইন তৈরি হয় বা বাস্তবায়িত হয়, তত দিনে তার কার্যকারিতা হারিয়ে যায়।

এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এআই নিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত হবে ফাইন্যান্স বা আর্থিক ব্যবস্থাবিষয়ক বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ দেওয়া, যাঁরা বুঝতে পারেন বা যাঁদের এটা বোঝার ক্ষমতা আছে যে ফাইন্যান্সের জগতে এআইয়ের কী প্রভাব পড়তে পারে।

গত মাসে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ইউকে এআই সেফটি ইনস্টিটিউট শীর্ষক নিরাপত্তাবিষয়ক একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ঘোষণা দেন। হোয়াইট হাউসও ঠিক একই রকম আরেকটি প্রতিষ্ঠান তৈরির ঘোষণা দিয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এই দুটি প্রতিষ্ঠান উন্নত এআই মডেলের পরীক্ষা–নিরীক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

এআই নিরাপত্তাবিষয়ক শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেন, আইন করার আগে প্রথমে যুক্তরাজ্যকে বুঝতে হবে, এসব উন্নত এআই মডেলের সক্ষমতা ঠিক কতটুকু। সে জন্য তারা এই প্রতিষ্ঠান গড়ার ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্প্রতি এআই নিয়ে যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে, সেখানে দেশটির ফাইন্যান্সিয়াল কনডাক্ট অথরিটি অ্যান্ড প্রুডেনশিয়াল রেগুলেশন অথরিটিকে এআই ও আর্থিক খাতের যথাযথ নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

এআই মানুষের কাজ কেড়ে নেবে কি না, তা নিয়ে আছে জোর আলোচনা। এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, যেসব দেশে ব্যাপক হারে রোবট ব্যবহার করা হচ্ছে, যেমন জার্মানি, জাপান, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়া, সেই সব দেশে এখন পর্যন্ত বেকারত্ব সমস্যা হয়ে ওঠেনি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এসব দেশে উৎপাদনশীল খাতে কর্মসংস্থান বেশি। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, যত বেশি রোবট, তত বেশি উৎপাদন।