রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে দেওয়া ঋণে রাজস্বঝুঁকি

রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে দেওয়া ঋণের স্থিতি ৩ লাখ ৪ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৭.৭ শতাংশ।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)
ছবি: রয়টার্স

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) মনে করে, রাষ্ট্রায়ত্ত ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোকে ঋণ দেওয়া বাংলাদেশের রাজস্বঝুঁকির অন্যতম কারণ। সংস্থাটি বলেছে, এসব সংস্থাকে দেওয়া অর্থ বেশির ভাগ সময়ই অর্থ ফেরত আসে না। সে জন্য রাজস্ব স্বচ্ছতার স্বার্থে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের উচিত হবে এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া। সংস্থাগুলোকে কোম্পানি আইনের আওতায় নেওয়া যায় কি না, তা বিবেচনা করার পরামর্শও দিয়েছে সংস্থাটি।

আইএমএফ যে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণসহায়তা অনুমোদন করেছে, তা থেকে এখন পর্যন্ত দুই কিস্তিতে অর্থ পেয়েছে বাংলাদেশ। গত ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির অর্থছাড়ের আগে রাজস্বঝুঁকিবিষয়ক একটি প্রতিবেদন দিয়ে গেছে আইএমএফের দল। ওই প্রতিবেদনেই রাজস্বঝুঁকির বিষয় তুলে ধরার পাশাপাশি পরামর্শও দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি। 

শুধু ঋণ নয়, নিশ্চয়তাও একপর্যায়ে দায়ে রূপান্তরিত হতে দেখা যায়, যা খুবই অনভিপ্রেত। অনিয়ম ও অদক্ষতার কারণে লোকসানি প্রতিষ্ঠানকে টেনে বেড়ালে তো এগুলো চলতেই থাকবে ।
আহসান এইচ মনসুর নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই

রাজস্বঝুঁকি কমাতে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের করণীয় কী, তা ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এদিকে আইএমএফের আরেকটি দল এখন ঢাকায় রয়েছে। দলটি ১৭ মার্চ পর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে বৈঠক করবে। সফররত দলটি আগের প্রতিবেদনের সুপারিশগুলোর অগ্রগতি নিয়ে অর্থ বিভাগের সঙ্গে কথা বলবে বলে জানা গেছে।

আইএমএফের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোকে দেওয়া মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৭ দশমিক ৭ শতাংশের সমান।

সরকারি প্রতিবেদন অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী, ৪৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার মধ্যে ২০২৩ সালের ২৩ মে পর্যন্ত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনসহ (বিপিসি) ১০টিরই ২০ হাজার ৭৮৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। এর মধ্যে বিপিসির ৭ হাজার ৮৮ কোটি টাকা ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) ৬ হাজার ৯৬৯ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। আইএমএফের প্রতিবেদনমতে, সরকারের দেওয়া ঋণের ৯০ শতাংশই রয়েছে ৯টি বড় সংস্থার কাছে, যার মধ্যে ছয়টির আর্থিক অবস্থা উচ্চমাত্রায় দুর্দশাগ্রস্ত।

আরও পড়ুন

রাজস্বঝুঁকি প্রতিবেদনের (এফআরএস) তথ্যসহ অর্থ বিভাগ গত বছর যে মধ্যমেয়াদি সামস্টিক অর্থনীতির নীতি–বিবৃতি প্রকাশ করেছে, সেটিকে স্বাগত জানিয়েছে আইএমএফ। সংস্থাটি বলেছে, পরের নীতি বিবৃতিটি আরও গভীর এবং বিশ্লেষণধর্মী হওয়া উচিত হবে, যাতে স্বচ্ছ রাজস্বঝুঁকির চিত্র বোঝা যায়। সংস্থাগুলোর তথ্য-উপাত্তে অনেক গরমিল থাকে উল্লেখ করে আইএমএফ বলেছে, এ ব্যাপারে অর্থ বিভাগ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভূমিকা রাখতে পারে।

রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো সময়মতো নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করে না বলে অভিযোগ রয়েছে। আইএমএফ বলেছে, সংস্থাগুলো যেন যথাসময়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদন দাখিল করে সে ব্যাপারে অর্থ বিভাগ একটা সময়বদ্ধ পরিকল্পনা তৈরি করবে এবং সংস্থাগুলোর সার্বিক বিষয়ে একটা তথ্যভান্ডার থাকবে। তথ্য-উপাত্তের গুণগত মানও থাকতে হবে।

করণীয় হিসেবে আইএমএফ বলেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোকে যেসব ঋণ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর হালনাগাদ তথ্যও থাকতে হবে। ঋণ আদায়ের পরিকল্পনাও থাকতে হবে অর্থ বিভাগের। আর এসবই করতে হবে চলতি মার্চ মাসের মধ্যে।

রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে শুধু ঋণ নয়, ঋণের নিশ্চয়তার (গ্যারান্টি) গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে আইএমএফ। বলেছে, চলতি পঞ্জিকা বছরের মধ্যে নিশ্চয়তা দেওয়ার প্রক্রিয়া অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ঋণের গ্যারান্টি তথা নিশ্চয়তার বিপরীতে মাশুল বা প্রিমিয়াম আরোপের নীতিমালা প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।

একটি অর্থবছরের খরচ মেটাতে সরকার বাজেটের ২৫ শতাংশই দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। একইভাবে সরকারি মালিকানাধীন আর্থিক ও অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্পগুলোকেও ঋণ নিতে হয়। এর ফলে সরকারের ওপর সেসব ঋণ নিয়ে একধরনের দায় তৈরি হয়। মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি–বিবৃতিতে এ ধরনের দায়কে ‘প্রচ্ছন্ন দায়’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

সাধারণত বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও কৃষিক্ষেত্রে নেওয়া ঋণের জন্য সরকার গ্যারান্টি (নিশ্চয়তা) বা কাউন্টার গ্যারান্টি দিয়ে থাকে। দেশি ব্যাংকের পাশাপাশি বিদেশি ব্যাংক থেকেও এ ঋণ নেওয়া হয়। চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছরের বাজেটে এমন দায়ের পরিমাণ ৯৮ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা।

বাজেট সংক্ষিপ্তসারে বলা হয়েছে, এসব ঋণের অর্থ প্রতিষ্ঠানগুলো ফেরত দিতে ব্যর্থ হলেই তা পরিশোধের দায়দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তায়। কাজেই সরকারের ভবিষ্যৎ আর্থিক অবস্থার ওপর প্রচ্ছন্ন দায়ের প্রভাব রয়েছে।

অনেক ক্ষেত্রে ঋণদাতা সংস্থাগুলো ঋণ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশ্বাস করতে চায় না বলেই সরকারকে এ গ্যারান্টি বা নিশ্চয়তা দিতে হয়।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, শুধু ঋণ নয়, নিশ্চয়তাও একপর্যায়ে দায়ে রূপান্তরিত হতে দেখা যায়, যা খুবই অনভিপ্রেত। অনিয়ম ও অদক্ষতার কারণে লোকসানি প্রতিষ্ঠানকে টেনে বেড়ালে তো এগুলো চলতেই থাকবে। ঋণ পরিশোধ না করায় এগুলো ইক্যুইটিতেও (মূলধন) পরিণত হয়।

আরও পড়ুন

সংস্থাগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বাংলাদেশ বিমানের উদাহরণ টানেন আহসান মনসুর। বলেন, একশ্রেণির আমলা যাতে বিজনেস শ্রেণিতে ভ্রমণ করতে পারেন, এ সুযোগটা তাঁরা হারাতে চান না। আর তাই বেসরকারি খাতে যাচ্ছে না বিমান। এ প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসা উচিত। এ ছাড়া আইএমএফের পরামর্শ অনুসরণ করে আপাতত ঋণ ও নিশ্চয়তার প্রক্রিয়াগুলোকে জবাবদিহির মধ্যে আনা উচিত।