মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই শুরুর আহ্বান

বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে। মূল্যস্ফীতি এখন উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো।

মূল্যস্ফীতি

সদ্য সমাপ্ত ফেব্রুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমেছে, তবে তা এখনো ৯ শতাংশের ওপরই আছে। এই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশে নেমেছে। আগের মাস জানুয়ারিতে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশে টানা এক বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপর অবস্থান করছে।

দীর্ঘদিন ধরে এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে। মূল্যস্ফীতির উচ্চহারকে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের মত, এই পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা উচিত।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য অবশ্য কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে সমন্বিত উদ্যোগের অভাব রয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। তিনি মনে করেন, বাজারে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা কোথায়, তা মূল্যায়ন করা জরুরি ছিল। কখন কোন পণ্য কী পরিমাণে আমদানি করা দরকার, তা নির্ধারণ করতে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের একযোগে কাজ করা দরকার। কিন্তু তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে বলেই মনে হচ্ছে।

সরকারের উচিত বাজারে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ করা। কিন্তু সে ধরনের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। মানুষের আয় বাড়লে তাঁদের পক্ষে একভাবে বাড়তি খরচ কুলিয়ে ওঠা সম্ভব হতো।
গোলাম রহমান, সভাপতি, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)

কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কতটা সমন্বয় হচ্ছে বা শুল্ক কমানোর ক্ষেত্রে এনবিআর কী করছে কিংবা কত দ্রুত পণ্য আমদানি করে ছাড় করা যায়, তা নিশ্চিত করতে তারা কী করছে—এসব বিষয়ে সামগ্রিকভাবে তাদের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি আছে বলে মত দেন সেলিম রায়হান।

মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা যেভাবে করা দরকার ছিল, তা সেভাবে হয়নি বলেই মনে করেন সেলিম রায়হান। তাঁর মতে, নীতি সুদহার আরও আগে থেকেই বাড়ানো দরকার ছিল। এ ছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে আমদানি শুল্ক আরও কমানোর সুযোগ ছিল, কিন্তু তা করা হয়নি।

এই পরিস্থিতিতে সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়াল। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ আরেক দফা বাড়তে পারে। এমনিতেই ব্যবসায়ীদের সামাল দেওয়া যায় না। বিদ্যুতের দাম বড়ার সুযোগে তাঁদের আরও লাগামছাড়া হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সেলিম রায়হান বলেন, রোজার ঠিক আগে আগে টিসিবি পরিবার কার্ডের মাধ্যমে যে চিনি বিক্রি করে, তার দাম কেজিপ্রতি ৩০ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে তা আবার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই প্রত্যাহার করা হলো। এটা অদ্ভুত কাণ্ড। কিন্তু বাজারে এ ধরনের ঘোষণার প্রভাব পড়ে। এতে বোঝা যায়, নীতিনির্ধারকেরা পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং তাঁদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব আছে।

মূল্যস্ফীতি মূলত বিদেশ থেকে এসেছিল, তা ঠিক। কিন্তু অন্যান্য দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যেসব চিরাচরিত ব্যবস্থা নিয়েছে, আমরা সেভাবে নিতে পারিনি বলে মনে করেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি বলেন, ‘আমাদের নীতি সুদহার বাড়াতে দেরি হয়েছে। তখন দেশে সুদহারের নয়-ছয় ব্যবস্থা ছিল। সে কারণে হয়তো নীতি সুদহার বাড়াতে দেরি হয়েছে। সেই সঙ্গে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। ফলে মুদ্রাস্ফীতিও ঘটেছে। এখন আমরা নীতি সুদহার বাড়াচ্ছি। কিন্তু কথায় আছে না, সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়।’

আরেকটি বিষয় হলো, মুদ্রা বিনিময় হার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বাজারে ডলার-সংকট সৃষ্টি হলে দেশে টাকার বিনিময় মূল্য কমে যায়। সেই পতনের ধারা অব্যাহত আছে। ফলে এখন বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও দেশীয় বাজারে দাম কমছে না বলে মনে করেন গোলাম রহমান।

মুক্তবাজার-ব্যবস্থায় ভোক্তা স্বার্থ রক্ষায় প্রতিযোগিতা থাকা দরকার। এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা হওয়া উচিত ফুটবল খেলার রেফারির মতো। কিন্তু আমাদের সরকার তা পারেনি। একসময় যে পণ্যের আমদানিকারক ছিল ৩০-৪০ জন, এখন তা কমে পাঁচ-ছয় জনে নেমে এসেছে। এতে প্রতিযোগিতা কমে গেছে। নতুন করে কেউ বাজারে ঢুকতে চাইলেও তাদের পক্ষে নেটওয়ার্ক ভাঙা সম্ভব নয়। এখানে যে যেভাবে পারছে, বাড়তি খরচ উঠিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।

এই পরিস্থিতিতে গোলাম রহমান মনে করেন, সরকারের উচিত, বাজারে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ করা। কিন্তু সে ধরনের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। মানুষের আয় বাড়লে তাঁদের পক্ষে একভাবে বাড়তি খরচ কুলিয়ে ওঠা সম্ভব হতো।

মূল্যস্ফীতি একধরনের করের মতো, এতে ধনী-গরিবনির্বিশেষে সবার ওপর চাপ বাড়ে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার অর্থ হলো, গরিব ও মধ্যবিত্তের সংসার চালাতে ভোগান্তি বৃদ্ধি পাওয়া। এমনিতে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেশ চড়া। তার সঙ্গে চিকিৎসা, পরিবহনসহ খাদ্যবহির্ভূত খাতেও খরচ বেড়েছে। সব মিলিয়ে মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন মানুষ।

এদিকে সানেমের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, শহরের প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলো গড়ে তাদের মোট খরচের ৬১ দশমিক ৩১ শতাংশ খাদ্যের পেছনে ব্যয় করে; গ্রামীণ প্রান্তিক গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে তা ৬৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির কারণে তাই প্রান্তিক মানুষ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন।