বিনিয়োগে মন্দা, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমেছে

টাকাফাইল ছবি

বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি তলানিতে নেমেছে। গত নভেম্বর মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধি গত সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বেনামি-জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ বিতরণ কমে আসায় এবং দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত ও পর্ষদে পরিবর্তন হয়েছে এমন ১১টি ব্যাংকের নতুন ঋণ প্রদান বন্ধ থাকায় এমন পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। এই ব্যাংকগুলো অবশ্য আমানতকারীদের টাকার চাহিদা মেটাতেই এখন হিমশিম খাচ্ছে।

বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমে আসায় অনেক ব্যাংক সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। এতে ঋণের চেয়ে বেশি মুনাফা মিলছে। কারণ, ঋণ দিলে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি থাকে আর বিল ও বন্ডে মুনাফা নিশ্চিত হয়। ফলে বিদায়ী ২০২৪ সালের কিছু ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় অনেক প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের নভেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ হয়েছিল, যা ২০২১ সালের মে মাসের পর সর্বনিম্ন। ওই বছরের মে মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ। গত নভেম্বরে অর্জিত প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে নিচে রয়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে জুলাই-ডিসেম্বরের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ৯ দশমিক ৮ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল।

কমেছে আমদানি

বিনিয়োগের জন্য প্রধান উপাদান ধরা হয় মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিকে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাস জুলাই-নভেম্বরে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খোলা ২০২৩–২৪ অর্থবছরের একই সময়ে তুলনায় ২৬ শতাংশ কমেছে। একইভাবে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে প্রায় ২২ শতাংশ। মূলধনি যন্ত্রপাতির ঋণপত্র খোলা ও নিষ্পত্তি কমার অর্থ দেশে নতুন বিনিয়োগ কমেছে।

একইভাবে মধ্যবর্তী পণ্য আমদানিও কমেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে মধ্যবর্তী পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র খোলা কমেছে ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। একই ময়ে মধ্যবর্তী পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ১৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ। তবে শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র খোলা আগের চেয়ে ৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ ও ঋণপত্র নিষ্পত্তি ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ বেড়েছে।

সাধারণত এসব পণ্য আমদানিতে ব্যাংক ঋণ দিয়ে থাকে। প্রথমে নন–ফান্ডেড ঋণ তৈরি হয়, যা ফান্ডেড হয়ে অনেক সময় মেয়াদি ঋণে রূপ নেয়। ফলে নতুন বিনিয়োগ বা সম্প্রসারণ কমে আসার কারণেও বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমেছে।

সুদহারও ঊর্ধ্বমুখী

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়ানোর উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছে। এ জন্য দফায় দফায় নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। ফলে ব্যাংক ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এ কারণে অনেকে বিনিয়োগ থেকে পিছিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়া বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও শ্রম অসন্তোষের কারণে বিনিয়োগ কমেছে। বিনিয়োগ কমার আরও কারণ আছে। বছরের পর বছর বিভিন্ন সমস্যার কারণে আগে থেকেই বিনিয়োগে গতি কম ছিল। বেসরকারি বিনিয়োগ তিন বছর ধরে কমছিল।

গত মাসে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) প্রকাশিত এক জরিপের ফলাফলে বলা হয়, দেশে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল চ্যালেঞ্জ দুর্নীতি। চলতি বছরও প্রায় ১৭ শতাংশ ব্যবসায়ী দুর্নীতিকেই ব্যবসায়ের প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দুর্নীতিসহ অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা, বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে অস্থিরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অদক্ষ আমলাতন্ত্র, উচ্চ করহারসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে ১৭টি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেন ব্যবসায়ীরা।

এখন অনেকেই বিনিয়োগ করতে ভয় পাচ্ছেন। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও কমেছে। ফলে ঋণের চাহিদা কমে গেছে। এতে কর্মসংস্থান ও কর আদায় দুটোই বাধাগ্রস্ত হবে, যা অর্থনীতি ও দেশের জন্য ভালো না
আনিস এ খান, সাবেক চেয়ারম্যান, এবিবি

তবে ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সুদহারের সঙ্গে বিনিয়োগের সম্পর্ক খুব কম। ২০২০ সালে সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার পরও বিনিয়োগ বাড়েনি। পরিবেশ ঠিক ও চাহিদা থাকলেই উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করবেন। সুদহারের কারণে কেউ বসে থাকবেন না।

অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত অনেকের ব্যবসা সীমিত হয়ে পড়েছে বা বন্ধ হয়ে গেছে। আবার পর্ষদে পরিবর্তন আনা ১১টি ব্যাংকও তাদের ঋণ বিতরণ কার্যক্রম প্রায় বন্ধ করে রেখেছে। কারণ, এসব ব্যাংক গ্রাহকের জমা টাকা তোলার চাহিদা মেটাত গিয়েই হিমশিম খাচ্ছে। এর মধ্যে ৯টি ব্যাংক ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সাইফুল আলমের (এস আলম) নিয়ন্ত্রণে। বাকি একটি ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও অন্যটি সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণে।

সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের পোশাক ও বস্ত্র খাতের ১৬টি কারখানা গত ডিসেম্বরে বন্ধ হয়ে যায়। এতে ৩০ হাজার শ্রমিক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন। ঋণখেলাপি হওয়ার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণসুবিধা বন্ধ করা হয়েছে। তাতে তাদের কাঁচামাল আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। আবার পণ্য রপ্তানি হওয়া ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা বিদেশ থেকে আনছে না গ্রুপটি। দেশের ১৬টি ব্যাংক ও ৭টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে বেক্সিমকো গ্রুপের ৭৮টি প্রতিষ্ঠানের দায়ের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে রুলের শুনানিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী এ তথ্য জানান।

এ ছাড়া সাবেক সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন আটটি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এস আলমের ছেলে আহসানুল আলমের ইনফিনিয়া গ্রুপ ও জামাতা বেলাল আহমাদের ইউনিটেক্স গ্রুপের অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। বিভিন্ন ব্যাংকে এস আলম–সংশ্লিষ্ট ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি।

গত বছরের শুরুতে জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে মোটাদাগে অর্থনীতিতে তিনটি সমস্যা ছিল। সেগুলো হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যহীনতা ও আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা অর্থনীতিকে টেনে তুলতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ব্যবসায়ীরা এখনো সন্তুষ্ট না। বেড়েছে ব্যাংকঋণের সুদের হার ও খেলাপি ঋণ।

জানতে চাইলে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান প্রথম আলোকে বলেন, এখন অনেকেই বিনিয়োগ করতে ভয় পাচ্ছেন। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও কমেছে। ফলে ঋণের চাহিদা কমে গেছে। এতে কর্মসংস্থান ও কর আদায় দুটোই বাধাগ্রস্ত হবে, যা অর্থনীতি ও দেশের জন্য ভালো না। সে জন্য বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি করতে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।